• ঢাকা
  • রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

‘পরীক্ষা বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যাই’


জামালপুর প্রতিনিধি
প্রকাশিত: মার্চ ১৯, ২০২২, ০৯:৪১ এএম
‘পরীক্ষা বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যাই’

জামালপুর সদর উপজেলার রানাগাছা ইউনিয়নের দড়িহামিদপুর গ্রামের বাসিন্দা যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ মো. সুরুজ্জামান খান। তিনি ওই গ্রামের মৃত ইউসুফ আলী খানের ছেলে। তারা আট ভাই ও পাঁচ বোন। ভাইদের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি নান্দিনা মহারাণী হেমন্ত কুমারী সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। পরীক্ষা বাদ দিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।

সুরুজ্জামান খান বলেন, “আমরা ২৩ জনের একটি দল ‘নান্দিনা পূর্ববাজার গোদারাঘাট’ দিয়ে নৌকাযোগে শেরপুরের নকলার উপজেলার চন্দ্রকোনা এলাকায় এক মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে যাই। সেখান থেকে আমাদের দলটি ট্রেনিং গ্রহণের জন্য সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে প্রবেশ করি। যুদ্ধের সময় কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ১১ নম্বর সেক্টর। ১১টি ভাগে বিভক্ত ছিল সেক্টরটি। এগুলো হলো জামালপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইল ও যমুনা নদীর তীরাঞ্চল। এছাড়া কুড়িগ্রামের রৌমারী, রাজিবপুর, চিলমারী, উলিপুর ও গাইবান্ধার ফুলছড়িঘাট ও সাঘাটা ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল।”

বীর মুক্তিযোদ্ধা আরও বলেন, “১১ নম্বর সেক্টর আবার ৭টি সাব সেক্টরে বিভক্ত ছিল। এর মধ্যে ভারতের ঢালু সাব সেক্টরে আমরা ৩৩দিন গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। সাবেক ধর্মমন্ত্রী মো. মতিউর রহমান আমাকে সিলেকশন করেন। রানাগাছা ইউনিয়ন কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সামাদ, শাহ আলী, আজিজুর রহমান ও তারা মহুরী প্রমুখকে সঙ্গে নিয়ে কামালপুরে ৪ নম্বর বাংকারে অবস্থান নিই। কামালপুর রণাঙ্গনে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে আমরা একাধিকবার সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হই। যুদ্ধচলাকালীন একপর্যায়ে আমি একাই বাংকারে অবস্থানের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরপর তিনটি মর্টার শেল নিক্ষেপ করে। দ্বিতীয় শেলটি আমার আমার ওপর এসে পড়লে আমার শরীর ঝাঁজরা হয়ে যায়। আমি গুরুতর আহত হই। মৃত ভেবে সহকর্মীরা আমাকে গুরুতর আহতাবস্থায় ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্পে নিয়ে যায়। আমিসহ অপর একজনকে সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারযোগে ভারতের শিলং হাসপাতালে নিয়ে যায়।”

“শিলং হাসপাতালে ২৮ দিন চিকিৎসার পর আমাদের আসামের গৌহাটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গৌহাটি হাসপাতালে আমিসহ গুরুতর আহত অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় এক মাস চিকিৎসা নিতে হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর শেলের আঘাতে আমার বুকের পাঁজরের হাড় ও ঘারের হাড় ভেঙে যায়। বাঁ হাত উপড়ে যায়। চিকিৎসকরা আমার শরীরের নানা স্থান থেকে মাংস নিয়ে পাঁজরে ও বুকে স্থাপন করে। চিকিৎসকরা আমার দুই পায়ের রগ দিয়ে স্যালাইন ও ইনজেকশন দেন। হাসপাতালের শয্যা থেকে উঠে দাঁড়াতে পারতাম না। ভালোভাবে কথা বলতে পারতাম না। হাত-পা নাড়াতে পারতাম না। মর্টার শেলের আঘাতে জখম হওয়া বাঁ হাত কেটে ফেলেন। আর এতে আমি চিরদিনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করি। আমার সুস্থতায় ডাক্তার আমার শরীরে মোট ৭টি অপারেশন করে।”

সুরুজ্জামান আরও বলেন, “আমাকেসহ অন্য যুদ্ধাহতদের দেখতে ছুটে আসেন ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল এম এ জি ওসমানী প্রমুখ। সেখানে আমাকে কৃত্রিম হাত লাগিয়ে দেওয়া হয়। হাত লাগানোর পর আমাকে কলতাকায় নিয়ে আসা হয়। সেখান থেকে ঢাকায় আনা হয়। আমিসহ একাধিক মুক্তিযোদ্ধা ঢাকা কলেজ গেটসংলগ্ন সরকারি কোয়ার্টারে অবস্থান করি। সেখানে থাকার পর আমার বাবা ও ভাইয়েরা আমাকে বাড়ি নিয়ে আসে। আমি ১৯৭২ সাল থেকে মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা পেয়ে আসছি।”

মুক্তিযুদ্ধের ওপর নানা বিষয়ে কথা হলে একপর্যায়ে তিনি দুঃখ, ক্ষোভ ও অভিযোগের কথাও শোনান।

যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, “এমন কিছু মানুষ রয়েছেন যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে বীর মুক্তিযোদ্ধার খাতায় নিজের নাম লিখিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধার সম্মানী ভাতা উত্তোলন করছেন। এটা খুবই দুঃখজনক।”

সুরুজ্জামান বলেন, “তৎকালীন জেলা প্রশাসক সাহেব আমার নিজ এলাকায় একটি সড়ক আমার নামে নামকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এজন্য জেলা প্রশাসকের আর্থিক সহযোগিতায় চকবেলতৈল বাজার থেকে শুরু করে আমার নিজ বসতবাড়ির সামনে দিয়ে বানারেরপাড় পর্যন্ত রাস্তা ‘যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা সুরুজ্জামান খান’ সড়ক রাখার ব্যবস্থা করেন। এজন্য সড়কের মাথায় ‘শ্বেতপাথরে’র একটি নামফলক স্থাপন করা হয়। কিন্তু রাতের আঁধারে রাজাকারের দল আমার নামফলকটি উপড়ে ফেলে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। বর্তমানে নামফলকের চিহ্নটুকু নেই, যা আমাকে দারুণভাবে ব্যথিত করেছে। শেষ জীবনে কারো কাছে আমার চাওয়া-পাওয়ার কিছুই নেই। তবে জানা-অজানা শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবরের সঠিক সংরক্ষণ, নামকরণ, নামফলক, স্মৃতিচিহ্ন রক্ষায় সব রকম পদক্ষেপ নেওয়া খুবই প্রয়োজন। আগামী দিনের প্রত্যেক প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিতে এবং তাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে।”

Link copied!