“মাইনসে আগে দূর-দূর ছাই ছাই করত। কারও বাড়িতে সহজে কেউ থাকতে দিত না। উপায়ান্তর না পাইয়া গোয়ালঘর, পরিত্যক্ত ঘরবাড়ি আর মাইনসের রান্দা (রান্না) ঘরের বারিন্দায় থাকতাম ঘুমাইতাম। প্রধানমন্ত্রী আমারে ঘর দিছে। স্বপ্নেও ভাবিনাই, ইটের ঘর পামু। আমি ভীষণ খুশি। মাথা গুঁজার ঠাঁই পাইয়া এহন এইহানেই থাহি। খাই আর না খাই নিজের ঘরত (ঘরে) ঘুমাই। আমারে কেউ আর মন্দ কতা কইতে পারে না। এহন দুইমুঠ খাবারের ব্যবস্থা হইলেই জীবনের শেষ বেলায় আরও ভালা যাইব।”
কথাগুলো বলছিলেন, শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার রানীশিমুল ইউনিয়নের হিন্দুপাড়া গ্রামে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের উপকারভোগী হতদরিদ্র প্রসাধনী রানী বর্মণ (৯০)।
কথা হয় বয়সের ভারে জবুথবু হয়ে পড়া প্রসাধনীর সঙ্গে। বার্ধক্যজনিত কারণে তার মুখের প্রতিটি শব্দই বারবার জড়িয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ঘর পাওয়ার আনন্দের ঝিলিক তার চোখ মুখজুড়েই ছিল।
প্রসাধনী বলেন, “এহন হাত পাও চলে না। শরীর কাফে। মাইনসের বাড়ি বাড়ি যাইয়া এহন আর কাজও করবার পারি না, ভিক্ষাও করতে পারি না। বিধবা ভাতার ট্যাহা হাতে পাইলে কয়ডা দিন ভালাই যায়। আর ট্যাহা শেষ হইয়া গেলে এর ওর কাছ থ্যাইয়া চ্যাইয়া-চিন্তা খাই।”
কথা প্রসঙ্গে জানা যায়, তার বাবা থাকতেন পার্শ্ববর্তী ঝিনাইগাতী উপজেলার কুচনিপাড়া গ্রামে। একই উপজেলার খলচান্দা গ্রামের জিতেন চন্দ্র বর্মণের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে স্বামীহারা হন প্রসাধনী। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে ছোট ছোট পাঁচ ছেলেমেয়ে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন তিনি। সহায় সম্বল বলতে তার কিছুই ছিল না। অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ বা কখনও ভিক্ষাবৃত্তি করে তার সংসার চলত। পেটের তাগিদে এক সময় কাজের সন্ধানে চলে আসেন শ্রীবরদীতে। ভাসমান অবস্থায় কারো দয়া দাক্ষিণ্যে গোয়াল ঘর, পরিত্যক্ত ঘর বাড়ি বা কখনও রান্নাঘরের বারিন্দায় রাত কাটাতেন প্রসাধনী। এ অবস্থায় ছেলেমেয়েরাও বড় হতে থাকে। একসময় তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। আর ছেলেরাও কাজের সন্ধানে ঢাকায় চলে যায়। এক ছেলে ঢাকায় রিকশা চালায়, আরেক ছেলে একটি কারখানায় শ্রমিকের কাজ করেন। ছেলেরাও সংসারী হয়েছে।
এক বছর আগে শ্রীবরদী উপজেলার রানীশিমুল ইউনিয়নের হিন্দুপাড়া গ্রামে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ওই প্রকল্পে ঘর পান প্রসাধনী। এখন বড় ছেলে মাঝে মাঝে মাকে দেখতে গুচ্ছ গ্রামে আসেন।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা জমিরুল ইসলাম, রাজা মিয়া ও আমিনুল ইসলাম বলেন, প্রসাধনীর ছোট মেয়ে জ্যোতিও তার মা’র সঙ্গে থাকে। জ্যোতির স্বামী ভবঘুরে। দুই বছর বয়সী এক কন্যা সন্তান নিয়ে সে-ও এখন আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা। মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে মা-মেয়ের সংসার কোনো রকমে চলছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান বলেন, ওই আশ্রয়ণ প্রকল্পটি ২০২০-২১ অর্থবছরে নির্মাণ করা হয়। মোট দশটি পরিবার উপকারভোগী হিসাবে সেখানে আশ্রয় পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের দিক নির্দেশনায় স্থানীয় ভূমি অফিসের কর্মকর্তারা ওই সব উপকারভোগীদের নামে দুই শতাংশ খাস জমি বন্দোবস্ত করে দেয়। পরে সেখানে প্রতিটি পরিবারের জন্য দুইটি বেডরুম, একটি বাথরুম, একটি রান্নাঘর করে দেওয়া হয়। আর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে বিনা মূল্যে সুপেয় পানি ও বিদ্যুৎ বিভাগ বিদ্যুতের কাজ সম্পন্ন করে।
জিয়াউর রহমান আরও জানান, প্রকল্পে আশ্রয়প্রাপ্তরা প্রতি ঈদে সরকার কর্তৃক বরাদ্দকৃত ভিজিএফের চাল, শুকনো খাবার ও কম্বল পেয়ে থাকেন। এছাড়া সেখানে কেউ কেউ বিধবা ভাতা এবং বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন। পাশাপাশি যুবক-যুবতীদের স্বাবলম্বী করতে প্রধানমন্ত্রী বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। এ জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঠাঁই পাওয়া যুবকদের যুব-উন্নয়ন অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছ। পরে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা যদি নিজেরা ব্যবসা-বাণিজ্য করতে চায় তাদের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।