প্রায় ২০০ বছর বয়সী বটবৃক্ষের নিচে সারিবদ্ধভাবে বিভিন্ন ফলের ঝুড়ি নিয়ে পূজার জন্য দাঁড়িয়ে থাকেন নববধূ থেকে শুরু করে দু-তিন সন্তানের জননীরা। তাদের সঙ্গে টুকটুকে রঙ্গিন ফুলেল সাজে দাঁড়িয়ে সনাতনী কুমারী মেয়েরা। সবার দৃষ্টি বটবৃক্ষের দিকে। সকাল গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কোলাহল। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে ভট্টপুর জয়রামপুর গ্রামের আদি বটবৃক্ষকে কেন্দ্র করে বউমেলার দৃশ্য এটি।
এ মেলাকে সনাতন ধর্মাবলম্বীর অনেকে সিদ্ধেশ্বরী দেবীর মেলা ও বটবৃক্ষকে সিদ্ধেশ্বরী দেবী বলে আখ্যায়িত করেন। পুরানো এ বটবৃক্ষকে কেন্দ্র করে যুগ যুগ ধরে পালিত হচ্ছে এ বউমেলা। বৈশাখের দ্বিতীয় দিন থেকে (সনাতনী পঞ্জিকা মতে পয়লা বৈশাখ, ১৫ এপ্রিল) এ বউমেলা শুরু হয়।
পহেলা বৈশাখ উদযাপন উপলক্ষে প্রতি বছর ঐতিহাসিক বউমেলা বসে। উপজেলা পরিষদের পাশে ভট্টপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে এ মেলা বসে। শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সিদ্ধেশ্বরী বটতলার পদতলে (সনাতন) হিন্দু সম্প্রদায়ের শত শত নর-নারীরা এ পূজায় অংশগ্রহণ করেন। তবে এবারে রমজান মাস হওয়ায় মেলার আয়োজন ও পরিধি ছিল কম।
স্থানীয় হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা জানান, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে এ বটবৃক্ষটি হয়ে উঠেছে পুণ্যের দেবতা। তাই হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে বটবৃক্ষটি সিদ্ধেশ্বরী দেবী নামে সুপরিচিত। বিশেষ করে সনাতন ধর্মাবলম্বী নারীরা সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন সিদ্ধেশ্বরী কালী তলার এ বউমেলার জন্য। এ বিশ্বাসেই এখানে বউমেলা অনুষ্ঠিত হয়। রেকাবি ভরা বৈশাখী ফলের ভোগ নিয়ে দলে দলে হিন্দু নারীরা হাজির হন বউমেলায়। পাশাপাশি দেবতার সন্তুষ্টির জন্য কবুতর ওড়ানো ও পাঁঠা বলি দেওয়া হয় বৃক্ষ দেবতার পদতলে। স্বামী সংসারের বাঁধন যেন অটুট থাকে, সারা বছর সুখ শান্তিতে যেন কাটে দাম্পত্য জীবন এই কামনাতেই পূজার করেন হিন্দু নারীরা।
বউমেলায় অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশ নারী হলেও পুরুষরাও এ মেলায় অংশগ্রহণ করেন। তবে সংখ্যায় তারা কম। রমণীরা হাতের রেকাবিতে তরমুজ, কাঁঠাল, কলা, আম, শশা, বাঙ্গিসহ মৌসুমি ফল নিয়ে লাইন ধরে বটবৃক্ষ তলে ভোগ দিয়ে পূজা অর্চনা করেন। মৌসুমি ফলের স্তূপ পড়ে যায় বট তলায়। ফল দিয়ে পূজা-অর্চনা শেষে ভক্তবৃন্দের মধ্যে প্রসাদ বিতরণ করা হয়। পহেলা বৈশাখের পরদিন শনিবার পূজার আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে শুরু হয় ৩ দিনব্যাপী বউমেলা। মেলায় পূজা অর্চনা ছাড়াও বাঙালি সংস্কৃতির প্রাচীন ঐতিহ্য খুঁজে পাওয়া যায়। এ বউমেলায় মৃৎশিল্পীদের তৈরি নানা রঙের, নানা বর্ণের টেপা পুতুল, হাতি, ঘোড়া, ময়না, টিয়া, বাঘ-ভাল্লুক, হাড়ি পাতিল থেকে শুরু করে মণ্ডা-মিঠাইয়ের দোকান বসে। বিভিন্ন মনোহারি জিনিসপত্রের পসরা বসে মেলায়। মৃৎশিল্প, লৌহশিল্প, কাঠ ও বাঁশের তৈরি লোকপণ্য ছাড়াও মেলায় পাওয়া যায় বাহারি মিষ্টান্ন সামগ্রী।
সনাতন ধর্মাবলম্বীর অনেকের মতে, বউমেলায় পূজা অর্চনা করলে পুরনো বছরের স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া বিবাদকে দূরে ঠেলে দিয়ে একজন বধূ যেন স্বামী সোহাগিনী হয়ে ওঠেন এবং নতুন বছরে স্বামীর সংসারকে ধন-ধান্যে ভরে তুলতে পারেন। এখানে অনেক ভক্ত দেবীর নামে পাঁঠা ও কবুতর উৎসর্গ করেন।
অনেকের বিশ্বাস বটমূলের মাটি শরীরের মাখলে রোগবালাই থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। প্রেমে সফল ও দ্রুত বিয়ের কাজ সম্পন্ন হওয়ার জন্য এ স্থানের মাটি খুবই উপকারী মনে করে এই দিনটিতে সনাতন ধর্মাবলম্বীর লোকেরা মাটি সংগ্রহ করে থাকেন।
মেলায় আসা নববধূ আরতি রানী সাহা, রঞ্জিতা দাস ও শিতুলী রানী পাল বলেন, “সংসারের সুখ শান্তি ও স্বামী সন্তানের মঙ্গল কামনায় আমরা এ মেলায় এসে পূজা করতে এসেছি। বড়দের কাছ থেকে শুনেছি, এ মেলায় এসে পূজা অর্চনায় স্বামী সন্তান ও সংসারের কল্যাণ কামনায় সফল হয়। তাই এসেছি এ মেলায়।”
পুরোহিত চন্দন ভট্টাচার্য জানান, এ বউমেলায় সকাল থেকে বিভিন্ন এলাকা থেকে নারীরা ভিড় করেন সিদ্ধেশ্বরী বটতলায়। সকালে আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে পূজা অর্চনা হয়ে মেলা শুরু হয়। এ মেলা পূজা অর্চনা মূলত একদিন। কিন্তু মেলা জমে ৩ দিন। এ মেলাটি নারী কেন্দ্রিক হলেও এখানে আসেন হিন্দু , মুসলমান সকল ধর্মাবলম্বীর মানুষ। আসেন বিদেশি পর্যটকরাও।
বউ মেলা আয়োজক কমিটির কর্মকর্তা নিলোৎপল রায় জানান, “নতুন বছর সবার জীবনে মঙ্গল বয়ে আনুক—এই আহ্বানের মধ্য দিয়ে এবারও বর্ষবরণ উৎসবে আমরা সিদ্ধেশ্বরী কালী পূজার আয়োজন করেছি। এবারে মেলা মুসলমানদের রমজান মাস হওয়ায় আয়োজন ছিল কম।”
সিদ্ধেশ্বরী বটতলার পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি মানিক ঘোষ জানান, সকলের সহযোগিতায় এ বউমেলায় পূজা অনুষ্ঠান শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়।
সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রেজওয়ান উল ইসলাম জানান, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বউমেলায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। মেলা উপভোগ করতে হিন্দু সম্প্রদায় ছাড়াও মুসলিম ধর্মের লোকজনও অংশ নেন।


















-20251029103315.jpeg)



















