তারেক রহমানের জন্য এসএসএফ নিরাপত্তা চায় বিএনপি; এখনও সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকার


সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৩, ২০২৫, ০১:২০ পিএম
তারেক রহমানের জন্য এসএসএফ নিরাপত্তা চায় বিএনপি; এখনও সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকার

নিরাপত্তাজনিত হুমকির কথা উল্লেখ করে যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফেরার আগে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) নিরাপত্তার আবেদন জানিয়েছে দলটি। 

তবে এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি।

প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা গত শনিবার এই আবেদনের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আবেদন পাওয়ার পর গত সপ্তাহে বিষয়টি নিয়ে অন্তত তিনটি বৈঠক করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। বৈঠকগুলোতে অংশ নেওয়া কয়েকজন জানান, এ নিয়ে কর্মকর্তারা মিশ্র মত দিয়েছেন। কোনো কোনো কর্মকর্তা অনুরোধের পক্ষে মত দিলেও কেউ কেউ এর বিরোধিতা করেছেন। তাদের যুক্তি, তারেক রহমান কোনো রাষ্ট্রীয় পদে নেই এবং তিনি বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী বা দলীয় চেয়ারপারসনও নন।

অবগত কর্মকর্তারা জানান, বৈঠকগুলোতে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও উপদেষ্টা পরিষদের কয়েকজন সদস্য উপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, নির্দিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ (ভিভিআইপি) ও সফররত বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধানদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকে এসএসএফ। তবে এই তালিকার বাইরে কাউকে এসএসএফ নিরাপত্তা দিতে হলে সাধারণত সরকারের বিশেষ সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হয়।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, তারেক রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এ কে এম শামসুল ইসলাম ডিসেম্বরের শুরুতে এসএসএফ নিরাপত্তার জন্য আবেদন করেন। দীর্ঘ ১৭ বছরেরও বেশি সময় নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে তারেক রহমানের সম্ভাব্য স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে কেন্দ্র করে গত জুনে তার জন্য বুলেটপ্রুফ গাড়ি ও বাড়তি নিরাপত্তার আবেদন করেছিলেন বিএনপির কোষাধ্যক্ষ রশিদুজ্জামান মিল্লাত।

প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, তারেক রহমান যদি গুলশানে তার মায়ের বাসভবনে অবস্থান করেন, তবেই কেবল এসএসএফ নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। কারণ খালেদা জিয়া ভিভিআইপি হওয়ায় তার বাসভবনটি ইতোমধ্যেই এসএসএফ নিরাপত্তার আওতায় রয়েছে।

'অন্যথায় তাকে আলাদাভাবে এসএসএফ নিরাপত্তা দেওয়া হলে অন্যান্য রাজনৈতিক দল থেকেও একই ধরনের দাবি ওঠার পথ প্রশস্ত হবে,' বলেন ওই কর্মকর্তা।

দলীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সীমাবদ্ধতা

বিএনপি চেয়ারপারসনের নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহী আকবর বলেন, সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও সদস্যদের নিয়ে গঠিত চেয়ারপারসন সিকিউরিটি ফোর্স (সিএসএফ) ভিড় সামলাতে সক্ষম হলেও বড় ধরনের বা উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ নিরাপত্তা হুমকি মোকাবিলার সক্ষমতা তাদের নেই।

তিনি আরও জানান, সিএসএফ একটি বাসভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলেও তারেক রহমান যখন প্রকাশ্যে চলাচল করবেন বা বড় জনসভায় অংশ নেবেন, তখন তাকে পূর্ণাঙ্গ সুরক্ষা দেওয়ার মতো সরঞ্জাম তাদের নেই। তিনি বলেন, 'এসএসএফ সবচেয়ে দক্ষ। তাদের ট্রেনিং দেওয়া হয় ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গলে। কোন কোন জায়গা থেকে হুমকি আসতে পারে, তারা সেদিকেই নজর রাখে, ডিফেন্স ম্যানেজমেন্টর জন্য সেরা এসএসএফ।'

অতীতের উদাহরণ টেনে আকবর উল্লেখ করেন যে, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের এসএসএফ নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছিল, যার মধ্যে ২০০৮ সালের নির্বাচনি প্রচারণার সময় খালেদা জিয়াও ছিলেন। তিনি বলেন, 'এখনো সরকার ইচ্ছা করলে এসএসএফ দিতে পারে। কারণ তারেক রহমানের নিরাপত্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে সদিচ্ছাই সবচেয়ে বড়।'

বিমানে নিরাপত্তার কড়াকড়ি

এদিকে এয়ারলাইন্স সূত্র জানিয়েছে, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকির আশঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটের দুইজন কেবিন ক্রুকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই ফ্লাইটেই তারেক রহমানের লন্ডন থেকে দেশে ফেরার কথা রয়েছে।

গত শনিবার রাতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সূত্রমতে, গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ওই দুই ক্রুর রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেবে বিমানের বিজি-২০২ ফ্লাইট। তারেক রহমান এই ফ্লাইটে চড়ে ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশে পৌঁছাবেন।

বিমানের ফ্লাইট সার্ভিস বিভাগ জানায়, এই ফ্লাইটে প্রথমে জুনিয়র পার্সার মো. সওগাতুল আলম সওগাত ও ফ্লাইট স্টুয়ার্ডেস জিনিয়া ইসলাম জিনিয়ার দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল। তবে পরে তাদের সরিয়ে ফ্লাইট পার্সার মোস্তফা ও স্টুয়ার্ডেস আয়াতকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

ঢাকায় নিরাপত্তা প্রস্তুতি

তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনকে কেন্দ্র করে ব্যাপক প্রস্তুতি শুরু করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, তার আগমনের দিন পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থার প্রায় ২ হাজার সদস্য মোতায়েন করা হতে পারে। 

নিরাপত্তা পরিকল্পনায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, সেখান থেকে এভারকেয়ার হাসপাতাল হয়ে গুলশান পর্যন্ত যাওয়ার রাস্তা ও তার বাসভবনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তবে চূড়ান্ত নির্দেশনা এখনো জারি হয়নি।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, গুলশানে খালেদা জিয়ার বাসভবন ও তারেক রহমানের বাসভবন দেয়ালঘেঁষা হওয়ায় দুটি বাসা ও তারেক রহমানের অফিসকে একই নিরাপত্তা পরিকল্পনার আওতায় আনা হচ্ছে। বিশেষ করে বাসা ও অফিসের মধ্যকার দূরত্ব ও চলাচলের পথকে নিরাপত্তা পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রমতে, ২৩ ডিসেম্বর মধ্যরাত থেকে পুলিশের বিশেষ নজরদারি শুরু হতে পারে। ২৫ ডিসেম্বর রুটজুড়ে প্রতিটি থানা এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হবে এবং বিশেষ এসকর্টসহ একাধিক চেকপোস্ট থাকবে।

বর্তমানে গুলশান, বনানী ও বারিধারা এলাকায় অন্তত ৯টি চেকপোস্ট চালু রয়েছে, যেখানে সার্বক্ষণিকভাবে ১৫০ জনেরও বেশি পুলিশ সদস্য নিয়োজিত আছেন। তারেক রহমানের আগমনের আগে চেকপোস্টের সংখ্যা আরও বাড়ানো হতে পারে; প্রয়োজন অনুযায়ী তার বাসভবনের আশপাশেও নিরাপত্তা বাড়ানো হবে।

প্রস্তুতির বিষয়ে গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) রওনক আলম বলেন, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট সমন্বিতভাবে নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছে। তবে এখনো চূড়ান্ত নির্দেশনা ঠিক হয়নি। 'আমরা নির্দেশনা অনুযায়ী সর্বোচ্চ নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করব।'

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা ফয়সান হাসান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তারেক রহমান ও খালেদা জিয়ার প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শামসুল ইসলামের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

২৭ ডিসেম্বর ভোটার হবেন তারেক রহমান

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ গতকাল নিশ্চিত করেছেন, তারেক রহমান লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পরপরই আগামী ২৭ ডিসেম্বর ভোটার হিসেবে নিবন্ধন করবেন।

আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান তিনি। সালাহউদ্দিন বলেন, তারেক রহমান ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশে পৌঁছানোর কথা রয়েছে।

তিনি বলেন, '২৫ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার। যেহেতু পরদিন শুক্রবার, তাই ২৭ ডিসেম্বর শনিবার তিনি ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করবেন।'

Link copied!