• ঢাকা
  • সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫

অস্তিত্ব হারাচ্ছে মালঞ্চ নদী


ফরিদপুর প্রতিনিধি
প্রকাশিত: জুলাই ৩০, ২০২৩, ০৩:০৪ পিএম
অস্তিত্ব হারাচ্ছে মালঞ্চ নদী

বাংলাদেশের মধ্যবর্তী জেলা ফরিদপুর গড়ে উঠেছে দেশের প্রধান নদী পদ্মার অববাহিকায়। আর এই জেলা শহরের কোলজুড়ে বয়ে চলা কুমার নদের পার্শ্ববর্তী সালথা উপজেলা সদর বাজার অতিক্রমকালে সৃষ্টি হয়েছে এর একটি শাখা নদী। যার নাম মালঞ্চ। প্রায় ১২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে প্রবাহিত মালঞ্চ নদীর অস্তিত্ব জড়িয়ে রয়েছে কয়েকশ বছরের ইতিহাস। আর এ নদীর নামকরণের সঙ্গেও রয়েছে এক শোকগাথা।

মাত্র ৩০ থেকে ৪০ বছর আগেও মালঞ্চ নদী ছিল নানান জাতের দেশীয় মাছের সম্ভারে পরিপূর্ণ। স্থানীয়রা সেই মাছ শুটকি দিয়েও সারা বছরের খাদ্য সংস্থানের জন্য রেখে দিতেন। কিন্তু কালের বিবর্তনে অনেক কিছুর সঙ্গে মালঞ্চ নদীও তার আগের রুপলাবন্য হারিয়েছে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো নদীর এমন সুন্দর একটি নামই হারাতে চলেছে। বর্তমান প্রজন্মের অনেকে জানেই না, ফরিদপুরে মালঞ্চ নামের একটি নয়নাভিরাম নদী রয়েছে। কিংবা নদীর পাড়ে বসত করেও এই প্রজন্মের অনেকে জানেনা, এই নদীর নাম মালঞ্চ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাতক্ষীরা জেলার সুন্দরবনের মধ্যে মালঞ্চ নামের একটি নদী রয়েছে। এই নামের নদী রয়েছে রাজশাহীতেও। সেসব নদীর মতো সুদীর্ঘ না হলেও ফরিদপুরের মালঞ্চ নদী অনেক পুরোনো। সালথার গট্টি বাজারে কুমার নদ থেকে উৎপত্তি লাভ করে সিংহপ্রতাপ, গৌড়দিয়া, সলিয়া, সেনহাটি, খাগৈড়, গোয়ালপাড়া, গোবিন্দপুর, দুর্গাপুর এই আটটি গ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে মালঞ্চ নদী। বিভিন্ন জনপদ ও গ্রাম ছাপিয়ে নদীটি ১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আবার কুমার নদের সঙ্গে মিশেছে। এ জন্য অনেকে এটিকে কুমার নদের অংশ মনে করেন। কেউ ভাবেন খাল।

শুকনো মৌসুমে খড়ায় পানি শুকিয়ে জেগে ওঠে মালঞ্চ নদীর উদামে শরীর। নদীটি সম্প্রতি খনন করা হয়েছে। এখন শুকনো মৌসুমে হাঁটু পানি থাকে কোথাও। বর্ষায় পানিতে ভরে ওঠে নদীর বুক। ফরিদপুরের প্রধান অর্থকরী ফসল পাট জাগ দেওয়া হয় বর্ষার মৌসুমে। পাটের পঁচা হাজামজা পানি নিয়েই বয়ে চলে সে। গ্রামের সহজসরল প্রকৃতির মতোই স্নিগ্ধতা মেশানো তার ছুটে চলা। সুন্দর স্নিগ্ধতা জড়ানো এই নদী যেন সকলের অগোচরে হারিয়ে যাচ্ছে। ফরিদপুরের সরকারি-বেসরকারি নথিপত্রে কোথাও নেই মালঞ্চ নদীর অস্তিত্ব।

স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের পরিচালক সুজিত দত্ত জানান, নবাবী আমলে স্থানীয় একজন জমিদার ছিলেন প্রতাপ সিংহ। তার মেয়ে মালঞ্চ নদীতে নৌকাডুবিতে মারা গেলে তার নাম অনুসারেই এই নদীর নাম হয় ‘মালঞ্চ’।

শ্রাবণ হাসান নামের স্থানীয় এক সংবাদকর্মী বলেন, “এমন একটি সুন্দর নামের নয়নাভিরাম নদী রয়েছে আমাদের সালথায় অথচ তেমনভাবে কখনো জানা হয়ে ওঠেনি। নতুন প্রজন্মের বেশিরভাগই এ নদীর নাম জানে না।

স্থানীয় সেলিম রানা নামের আরেক যুবক বলেন, “নিবীড় প্রকৃতির মাঝে বয়ে চলা মালঞ্চ নদীর অপরূপ দৃশ্য সকলকে আকৃষ্ট করে। নদীটি এখনো হারিয়ে যায়নি। তবে এই নদীর সুন্দর নামটি এখন হারাতে চলেছে।”

অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, “৬০ এর দশক থেকে ৮০ দশকেও এই নদীতে দেশীয় জাতের প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত মাছ শুকিয়ে শুটকি করে রাখা হত। এটি কোনো রুপকথা নয় বাস্তব সত্য কথা। সেই ভরা ঐশ্বর্যের মালঞ্চ নদী আজ শুধু তার নাব্যতাই হারায়নি, নামটিই হারাতে চলেছে।”

স্থানীয়দের মতে, নদীমাতৃক বাংলাদেশে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাব থেকে বাঁচতে হলে আরও অনেক নদ-নদীর মতো মালঞ্চ নদীর রুপলাবণ্য ফিরিয়ে আনা সময়ের অপরিহার্য দাবি।

ফরিদপুরের নাগরিক মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক পান্না বালা বলেন, “বর্তমান প্রজন্মের অনেকে এই নদীর নামই হয়তো জানে না। তবে নদীটি রক্ষা যেমন জরুরি, তেমনই মালঞ্চ নদীর নামটিও সরকারি নথিপত্রে উল্লেখ থাকা দরকার।”

এ ব্যাপারে সালথা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আক্তার হোসেন শাহিন বলেন, “এ নদীর বিষয়টি আমার জানা ছিল না। সাংবাদিকদের মাধ্যমেই আমি জানাতে পারলাম। এ ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিয়ে দেখব। আর যদি সরকারি নথিপত্রে এই নদীর নাম ও তথ্য না থাকে তাহলে তা অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আমাদের পক্ষ থেকে নেওয়া হবে।”

এ ব্যাপারে ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পার্থ প্রতিম সাহা বলেন, “নদী নিয়ে আমাদের নতুন করে আপডেট তালিকা করা হচ্ছে। যদি সেটা অন্তর্ভুক্ত না থাকে তবে নদীর শ্রেণির মধ্যে পড়লে সেটা অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এছাড়া জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে অন্যন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

Link copied!