• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ২২ শাওয়াল ১৪৪৫

সাড়ে চার শ বছরের ইতিহাস কথা বলে পাবনার শাহী মসজিদে


আরিফ আহমেদ সিদ্দিকী, পাবনা
প্রকাশিত: মার্চ ৩১, ২০২৩, ০৯:১৯ এএম
সাড়ে চার শ বছরের ইতিহাস কথা বলে পাবনার শাহী মসজিদে

বাংলার মুসলিম স্থাপত্যে নতুন একটি অধ্যায় সংযোজন হয়েছিল পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলায় ‘শাহী মসজিদ’ প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে। প্রায় সাড়ে চার শ বছর ধরে ৩ গম্বুজ নিয়ে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহ্যবাহী মসজিদটি।

দেওয়ালের ইট খসে যখন পুরোনো নিদর্শন আর ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছিলো, ঠিক সেসময় ১৯৮০ সালের দিকে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর পুরোপুরি সংস্কার করে মসজিদটি। বর্তমানে এটি সংরক্ষিত মসজিদ।

পাবনা-ভাঙ্গুড়া মহাসড়কে চাটমোহর পৌর এলাকার ভাদুরহাট মোড় থেকে ১ কিলোমিটার দূরে সুলতানী মোঘল আমলের নিদর্শন নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস ঐতিহ্যের ৪৪১ বছরের মসজিদটি।

চাটমোহরের তিন গম্বুজ শাহী মসজিদের শিলালিপিতে এর নির্মাতা ও নির্মাণকাল সম্বন্ধে জানা যায়। ওই শিলাফলকের ফার্সি লিপি থেকে জানা যায়, বিশাল এই মসজিদটি বিখ্যাত সুলতান সৈয়দ বংশীয় প্রধান সৈয়দ আবুল ফতে মুহাম্মদ মাসুম খাঁনের সময় নির্মিত হয়।  

কাকশাল গোত্রের সন্তান খান মুহাম্মদ তুর্কি খান ৯৮৯ হিজরি, অর্থাৎ ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে মসজিদটি নির্মাণ করেন। শিলালিপি পাঠ, অনুযায়ী অনুমান করা যায়, মাসুম খাঁন নিজেকে সুলতানরূপে ঘোষণা করেন। তিনি নিজে এই উপাধি গ্রহণ করেন। কিছুকালের জন্য পাবনা অঞ্চলে স্বাধীন সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন এবং চাটমোহরে রাজধানী স্থাপন করেন।

সম্প্রতি সরেজমিনে চাটমোহরে তিন গম্বুজ সমৃদ্ধ শাহী মসজিদে দেখা যায়, মসজিদটিতে তিনটি দরজা বিশিষ্ট প্রবেশপথ রয়েছে। প্রবেশপথের তিনটি দরজার মধ্যে প্রধান প্রবেশপথে উঁচু দরজার ওপরে কালো পাথরের মাঝে খোদাই করা ‘কালেমা শাহাদাৎ’ লেখা রয়েছে।

মূল প্রবেশ পথটি ছাড়া অন্য প্রবেশপথ দুটি একই ধরনের। মসজিদটিতে তিনটি প্রবেশপথের সঙ্গে মিল রেখে পশ্চিম দেওয়ালে রয়েছে মোট তিনটি মিহরাব।

কেন্দ্রীয় মিহরাব থেকে দুই পাশের মিহরাবে রয়েছে বড় সুরঙ্গের মতো অপূর্ব নিদর্শন। ভূমি-নকশালঙ্কারে স্থাপত্য। অনুমান করা যায়, সুলতানী-মুঘল স্থাপত্যের রীতিতে মসজিদটি নির্মিত।  

মসজিদের দেওয়াল প্রায় ৬ ফুট ৯ ইঞ্চি চওড়া। মিম্বারের পাশে কষ্টিপাথরের মত কালো রঙের পাথরটি সৌন্দর্যের আরেকটি অংশ। মসজিদের বাইরে জাফরান রঙের ‘জাফরী ইট’ ব্যবহৃত হয়েছে। ইটগুলো পাতলা এবং লম্বাটে।

দূর থেকে মসজিদটি বিশাল মনে হলেও ভেতরে মাত্র দুই কাতার লোক নামাজে দাঁড়াতে পারেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও জুমার নামাজ আদায় হয় এই মসজিদে। এ ছাড়া মসজিদের বাইরে দুটি ঈদের নামাজের জামাত অনুষ্ঠিত হয়।  

ইতিহাস থেকে জানা যায়, মাসুম খাঁন ছিলেন সম্রাট আকবরের অনুজ মির্জা মুহম্মদ হাকিমের দুধ ভাই। মাসুম খাঁ ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে খোরাসানের কাকশাল গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন।

সম্রাট আকবর বাংলা ও বিহারে বিদ্রোহ দমনে সমর্থ হলেও মাসুম খাঁন কোনোদিনই আকবরের আনুগত্য স্বীকার করেননি। পরে তিনি চাটমোহরে কিছু সময়ের জন্য একটি রাজ্য গড়ে তোলেন।  

সম্রাট আকবর তার শাসনামলে দ্বীন-ই-ইলাহি নামে নতুন ধর্ম ঘোষণা করলে কাকশাল গোত্র এবং বাংলার মুসলমান ভুঁইয়ারা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে ২০ বছর বয়সী যুবক মাসুম খাঁন ‘কালা পাহাড়’ নামের সেনাপতিকে যুদ্ধে পরাজিত করে স্বীকৃতি স্বরূপ পাঁচ হাজার সৈন্যের সেনাপতি পদে দায়িত্ব পান। ১৫৭৯ সালে মাসুম খাঁন বারো ভূঁইয়াদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে চাকরি ছেড়ে দিয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দেন।  

তিনি বারো ভূঁইয়াদের নেতা ঈসা খাঁনের সঙ্গে যোগ দিয়ে আকবরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যান। ১০০৭ হিজরি, অর্থাৎ ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে ৪৪ বছর বয়সে সম্রাটের ফৌজি বাহিনীর হাতে মৃত্যুবরণ করেন মাসুম খাঁন। সম্রাট আকবরের অধীনতা অস্বীকার করে চাটমোহরে স্বাধীন ক্ষমতা পরিচালনার সময় ৯৮৯ হিজরি অর্থাৎ ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে শাহী মসজিদটি নির্মাণ করা হয়।

চাটমোহরের শাহী মসজিদের দায়িত্বে রয়েছেন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাইট পরিচালক মো. শাহজাহান আলী। তিনি ৩৩ বছর ধরে এই শাহী মসজিদের দেখাশোনা করছেন। এ ছাড়া ওই মসজিদে একজন ঈমাম ও একজন মোয়াজ্জেম রয়েছেন।  

বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাইট পরিচারক শাহজাহান আলী জানান, নথিপত্রে চাটমোহর শাহী মসজিদ মাসুম খাঁনের নামে পাওয়া গেলেও সুলতানী-মোঘল আমলের শাহী মসজিদ মনে করে সারাবছরে বহু মানুষ আসেন পাবনার চাটমোহরে। দেশ-বিদেশ থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদরা আসেন তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ ও এর কারুকাজ দেখতে।  

Link copied!