• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১, ৭ শাওয়াল ১৪৪৫
নাজেহাল ৩৭ কৃষক

৪০০ টাকার জন্যও জেল খাটতে হয়েছে


পাবনা প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৫, ২০২২, ০৮:৪৬ পিএম
৪০০ টাকার জন্যও জেল খাটতে হয়েছে

সম্প্রতি ঋণ খেলাপি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে আলোচনায় আসা পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার ভাড়ইমারী গ্রামের ৩৭ জন কৃষক মূলত ঋণের সুদের ফাঁদে জড়িয়েছেন। অনেকে ঋণের টাকা সুদাসলে পরিশোধ করেছেন। কিন্তু ব্যাংকের সুদের চক্রবৃদ্ধির জালে কিভাবে জড়িয়েছেন তা টের পাননি। আর তাই তো ব্যাংকের মামলায় জেলে যেতে হয়েছে তাদের। দেখা গেছে, মাত্র ৪০০ টাকার জন্যও জেলে যেতে এক কৃষকের।

বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংকের গঠিত তিন সদস্যের কমিটি সোমবার (৫ ডিসেম্বর) দুপুরে ঈশ্বরদী উপজেলার ভাড়ইমারী গ্রামে কৃষকদের ঋণ খেলাপির বিষয়টির তদন্তে যান। তারা কৃষকদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন। কে কত ঋণ নিয়েছেন, আর কে কত পরিশোধ করেছেন, বকেয়া আছে কার কত টাকা। কৃষকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে এসব তথ্য ও কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করেন কমিটির সদস্যরা। সেখানে উঠে আসে নানা বিষয়।

সেখানে দেখা যায়, ঋণের সুদের হার চক্রবৃদ্ধি হয়েছে কয়েকগুণ। আবার ঋণের টাকা সম্পূর্ণ পরিশোধ না করায় কৃষকদের দুই থেকে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদ ধরেছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। কৃষক যে টাকা ঋণ নিয়েছেন তাদের কেউ কেউ সম্পূর্ণ টাকা সুদসহ ফেরত দিয়েছেন। কিন্তু তাদের নামের পাশে গত কয়েক বছরে সুদের টাকা বেড়েছে চক্রবৃদ্ধি হারে। যে সুদের টাকার কথা জানেন না অনেক কৃষক।

তেমনি একজন কৃষক ভাড়ইমারী গ্রামের মজনু প্রামানিক। তিনি জানান, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন ৪০ হাজার টাকা। তার দাবি, তিনি সুদ আসলে মোট পরিশোধ করেছেন ৫৫ হাজার ৫০০ টাকা। অথচ এখনো তার নামে সুদের বকেয়া দেখানো হয়েছে ৪ হাজার ৫০০ টাকা।

মজনু প্রামানিক বলেন, “এটা কোনো ধরনের কথা। আমি জানি সুদসহ টাকা পরিশোধ করে দিয়েছি। ব্যাংকও আমাকে কখনো বকেয়ার নোটিশ জানায়নি। তাহলে কেন আমার নামে মামলা হলো। এটা কেমন আইন।”

একই গ্রামের ভুক্তভোগী আরেক কৃষক আতিয়ার রহমান। তিনি জানান, তার নামে বকেয়া মাত্র ৪০০ টাকা। তার দাবি, তিনি এ টাকার কথা জানেন না। কখনো ব্যাংকের মাঠকর্মীরা বা কর্মকর্তারা বলেনি। আমি তো জানি আমার কোনো বকেয়া নাই। অথচ এই মাত্র ৪০০ টাকার জন্য আমাকে জেল খাটতে হলো।

আরেকজন কৃষক আব্দুস সামাদ প্রামানিক বলেন, “আমি ঋণ নিয়েছিলাম ৪০ হাজার টাকা। সুদসহ ফেরত দিয়েছি ৪২ হাজার টাকা। আজকে শুনতিছি আমার নামের এখনো সুদের ১২ হাজার টাকা বেশি বাকি। অথচ আমাকে জেলে যেতে হলো।”

এর আগে কোনো নোটিশ বা মামলা করার বিষয়ে ব্যাংকের লোকজন কিছুই জানায়নি বলেও দাবি করেন তিনি।

স্থানীয় কয়েকজন কৃষকের অভিযোগ, ব্যাংক মামলা করলেও তার আগে কোনো নোটিশ তারা পাননি। আর এই তদন্ত ব্যাংকের আইওয়াশ ছাড়া কিছু নয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক লিমিটেডের (পরিদর্শন) আহসানুল গণি বলেন, কৃষকদের অনেকে সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করেন নি। সেই টাকার সঙ্গে সুদের টাকা চক্রবৃদ্ধি হয়েছে। আবার অনেকে সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করলেও, সুদের টাকা পরিশোধ করেননি। সেই সুদের টাকাও চক্রাকারে বেড়েছে। এখানে ব্যাংকের নিয়মে যেটা ধার্য সেই টাকা কৃষকরা পরিশোধ না করায় মামলা হয়েছে। ৪০ জন কৃষক ঋণ নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে তিনজন সুদসহ টাকা পরিশোধ করায় তাদের নামে কোনো মামলা হয়নি। আমরা সব যাচাই-বাছাই করে তথ্য প্রমাণসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন জমা দেব। আর মামলার আগে কৃষকদের একাধিকবার নোটিশের মাধ্যমে জানানো হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

২০১৬ সালে ঈশ্বরদী উপজেলার ভাড়ইমারী গ্রামের ৪০ জন কৃষক বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক থেকে দলগত ঋণ হিসেবে ১৬ লাখ টাকা গ্রহণ করেন। এর মধ্যে কেউ ২৫ হাজার, কেউ ৪০ হাজার টাকা করে ঋণ পান। দীর্ঘদিনেও সেই ঋণ ও সুদের টাকা পরিশোধ না করায় ২০২১ সালে ৩৭ জন কৃষকের নামে মামলা করে ব্যাংকটি। সম্প্রতি আদালত তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে গত ২৫ নভেম্বর ১২ জন কৃষককে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠায় পুলিশ।

বিষয়টি গণমাধ্যমে আসার পর ব্যাপক আলোচনা, সমালোচনার সৃষ্টি হয়। গত ২৭ নভেম্বর পাবনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-২ এর ভারপ্রাপ্ত বিচারক শামসুজ্জামান গ্রেপ্তার ১২ কৃষকসহ ৩৭ জনের জামিন মঞ্জুর করেন।

পরে ২৯ নভেম্বর ৩৭ কৃষক তাদের সুদসহ ঋণের বাকি টাকা ও মামলা প্রত্যাহারের জন্য ব্যাংকের কাছে দাবি জানান। ভাড়ইমারী উত্তরপাড়া সবজি চাষী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সদস্য কৃষকদের পক্ষে বিলকিস নাহার এই আবেদন করেন।

এ ঘটনা তদন্তে গত ২৮ নভেম্বর বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক লিমিটেডের ডিজিএম (পরিদর্শন) আহসানুল গণিকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। তারা রোববার (৪ ডিসেম্বর) দুপুরে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।

Link copied!