• ঢাকা
  • রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১,

নওগাঁয় পাঁচ কারখানায় কোটি টাকার চুড়ি উৎপাদন


নওগাঁ প্রতিনিধি
প্রকাশিত: এপ্রিল ২৫, ২০২৩, ০৫:১৬ পিএম
নওগাঁয় পাঁচ কারখানায় কোটি টাকার চুড়ি উৎপাদন

নওগাঁ শহরের দপ্তরিপাড়ায় শেখ শিল্পালয় পিতলের কারখানায় সোনার বিপরীত ধাতু পিতল থেকে তৈরি হচ্ছে হাতের চুড়ি বা বালা। যা রুলিবালা হিসেবে পরিচিত। এই পিতলের চুড়িতে মাসিক আয় কোটি টাকা।

পিতলের কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, কারিগররা পিতলের পাত সাইজ করে কাটছেন, কেউ মুখ জোড়া দিচ্ছেন, আবার কেউ সেগুলোকে আগুনে পোড়াচ্ছেন। কেউ কেউ আবার ব্রাশ দিয়ে পরিষ্কার করে চুড়িতে সোনার রং দিচ্ছেন।

বর্তমানে ব্যাপক কদর বেড়েছে পিতল থেকে তৈরি এ চুড়ির। সোনার দাম যতই বাড়ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জন্য পিতলের তৈরি এ গয়নাটির চাহিদাও বাড়ছে। প্রতি মাসে নওগাঁয় ৫টি কারখানা থেকে প্রায় কোটি টাকার এসব চুড়ি উৎপাদন হচ্ছে।

জানা যায়, ২০১২ সাল থেকে জেলায় পিতল দিয়ে চুড়ি বা রুলিবালা তৈরির কার্যক্রম শুরু হয়। রুলিবালা তৈরির জন্য ঢাকা থেকে নিয়ে আসা হয় কাঁচামাল। এটি মূলত চায়না পিতলের পাত। প্রতি সপ্তাহে পাইকারি দামে ১৪০০ টাকা কেজি হিসাবে ২০০ কেজি (মাসে ১ টন) চায়না পিতলের পাত নিয়ে আসা হয়। ১ কেজি পিতলের পাত থেকে ৩৮-৪০ জোড়া চুড়ি তৈরি হয়। প্রতি জোড়া চুড়ি তৈরিতে পিতলের পাত, কেমিক্যাল, কাঁচা ধুপ, সরিষার তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ, শ্রমিকসহ খরচ পড়ে প্রায় ৬৫-৭০ টাকা। যা পাইকারি ১৭০-১৮০ টাকা মূল্যে বিক্রি করা হয়। খুচরা বিক্রি হয় ৩০০-৩৫০ টাকা জোড়া।

প্রথমে পিতলের পাত সাইজমতো কেটে পাইপ আকারে গোল করা হয়। তারপর গালা দিয়ে ভেতরের ফাঁপা অংশ ভরাট করে মুখ বন্ধ করে নকশা তৈরির জন্য বিভিন্ন গ্রামে নারী কারিগরদের কাছে পাঠানো হয়। নকশা করা ওই চুড়ি আবারও কারখানায় নিয়ে এসে গ্যাস দিয়ে পুড়িয়ে ভেতরের গালা বের করে কয়েক হাত বদল হয়ে ৩-৪ বার ওয়াশ করে সোনার রং করার পর এসব চুড়ি বগুড়া, নাটোর, রাজশাহী, ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়।

নওগাঁ জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে এমন কারখানা রয়েছে পাঁচটি। পাঁচটি কারখানা থেকে মাসে প্রায় ৫০ হাজার চুড়ি উৎপাদিত হয়। পাইকারি দরে যার মূল্য প্রায় ১ কোটি টাকা।

দপ্তরি পাড়ার কলেজ শিক্ষার্থী মুক্তি বলেন, “নকশা তৈরির জন্য কারখানার মালিক আমাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। প্রতি জোড়ায় নকশা তৈরিতে মজুরি ১৫ টাকা। সে হিসাবে প্রতিদিন প্রায় ২০০-২৫০ টাকা আয় হয়। এ কাজ করে যা পাওয়া যায় তা দিয়ে নিজের ও পড়াশুনার খরচসহ সাংসারিক কাজে সহযোগিতা করা যায়।” অনেক শিক্ষার্থী বাড়িতে বসে এ কাজ করে বাড়তি টাকা আয় করছেন।

মান্দা উপজেলার গনেশপুর গ্রামের গৃহবধূ আকলিমা বেগম বলেন, ছয় বছর আগে স্বামী অসুস্থ হয়ে মারা যান। তারপর সংসারে কষ্ট শুরু হয়। মানুষের বাড়িতে কাজ করতাম। ছেলেকে পড়াশোনা করানো কষ্টসাধ্য ছিল। পরে এ কারখানায় কাজ শুরু করি। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪-৫টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। গত তিন বছর থেকে কারখারায় কাজ করছি। শুরুতে প্রতি সপ্তাহে ৬০০ টাকা মজুরি পেতাম। এখন সপ্তাহে দেড় হাজার টাকা মজুরি পাই। চলতি মাস থেকে ২ হাজার টাকা মজুরি হওয়ার কথা। এছাড়া দুই ঈদে বোনাস পাওয়া যায়। বর্তমানে সংসার ভালোই চলছে।

এ বিষয়ে কারখানার মালিক শেখ কামাল বলেন, বাবা-দাদা স্বর্ণের কারিগর ছিলেন। পৈতৃক সূত্রে আমরা স্বর্ণের কারিগর। ব্যবসা মন্দা হওয়ায় ২০০৭ সালে পাড়ি জমাই দুবাইতে। এরপর আবারও ২০১২ সালে দেশে ফিরে কিছু করার চেষ্টা করি। সোনার দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় চায়না পিতল থেকে শুরু করা হয় হাতের চুড়ি তৈরি। বর্তমানে কারখানায় কাজ করছেন ১৫০ জন শ্রমিক এবং মাঠে কাজ করছেন আরও প্রায় ৬০০ জন। যাদের অধিকাংশই নারী শ্রমিক।

তিনি আরও বলেন, ভারতে এ চুড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তবে কিছু সমস্যার কারণে রপ্তানি করতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। চুড়ির ওজন বেশি হওয়ায় খরচও বেশি হয়। আবার অনেকেই ভাবে এটা ভারত থেকে আমরা নিয়ে আসি। কিন্তু আমরা দেশে চুড়ি তৈরি করে ভারতে পাঠাই। আমার কাছে মনে হয়েছে এটি ব্যাপক সম্ভবনাময় একটি শিল্প।

আরেক কারখানার মালিক পাপ্পা হোসেন বলেন, গত পাঁচ বছর থেকে রুলিবালা তৈরি করছি। ৫০ জন কারিগর কাজ করে আমার কারখানায়। এসব চুড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সোনা নাকি পিতলের চুড়ি সহজে কেউ বুঝতে পারবে না। সোনার দাম বৃদ্ধি হওয়ায় নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা এসব চুড়ি কিনছেন। সাধ্যের মধ্যে তাদের সখ পূরণ হচ্ছে। ব্যবসার পরিধি আরও বাড়ানোর ইচ্ছা। কিন্তু বর্তমানে কাঁচামালের দাম কিছুটা বেড়েছে। চুড়ির দাম আগামীতে আরও বাড়তে পারে।

এ বিষয়ে নওগাঁ বিসিক শিল্প নগরীর উপব্যবস্থাপক শামীম আক্তার বলেন, “ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোগকে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে। পণ্য প্রদর্শনীর জন্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে মেলার আয়োজন করা হয়। এ ক্ষেত্রে কারিগরি প্রশিক্ষণসহ সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।”

Link copied!