জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে মানুষের যে আশাভঙ্গ হয়েছিল, গত তিন মাসেও তার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এসব লক্ষণ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপজ্জনক।
শুক্রবার (১ নভেম্বর) সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নগরের ষোলোশহর রেলস্টেশনে আয়োজিত এক সমাবেশে আনু মুহাম্মদ এসব কথা বলেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা অধিকার রক্ষা পরিষদের ব্যানারে এ সমাবেশ হয়।
সমাবেশে আনু মুহাম্মদ বলেন, “আমরা যদি মনে করি, যে লঙ্কায় যায় সে–ই রাবণ হবে, তাহলে পরিবর্তন করে আর লাভ হলো না। এটি কী কারণে হয়, সেটি আমাদের বুঝতে হবে।”
আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, “কৃষক-শ্রমিকসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থ দেখার মতো রাজনৈতিক সংগঠিত শক্তি বাংলাদেশে তৈরি হয়নি। তৈরি হয়নি বলেই এত বড় একটি মুক্তিযুদ্ধের পরে, লক্ষ লক্ষ মানুষ শহীদ হওয়ার পরেও, বাংলাদেশে শোষক-লুটেরা শ্রেণি আবার নতুন করে তৈরি হয়েছে। নব্বইয়ে গণ-অভ্যুত্থান হলো, এরশাদ গেল, কিন্তু লুটেরা শক্তি আবার ক্ষমতায় থাকল। তিন মাস আগে এত বড় গণ-অভ্যুত্থানের পরেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন কিংবা ভবিষ্যৎ চিন্তায় সেই পরিবর্তনের লক্ষণগুলো দেখা যাচ্ছে না।”
সমাবেশে দেশে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি, বকেয়া বেতনের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর গুলি করার সমালোচনা করেন আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, “আমরা দেখি ছাত্ররা দিনের পর দিন সায়েন্স ল্যাব মোড় অবরোধ করে রাখে, কিন্তু শ্রমিকেরা বকেয়া মজুরির দাবি জানালে আগের সরকারের মতো গুলি করছে, বিভিন্ন অপবাদ দিচ্ছে। বলা হচ্ছে, এরা আওয়ামী লীগের লোকজন। আওয়ামী লীগ বললেই তো হবে না। আওয়ামী লীগ এখানে সুযোগ নিতেই পারে। সুযোগ নিতে সুবিধা তখনই হবে যখন এই সরকার আওয়ামী লীগের মতো ভূমিকা নেবে।”
দেশে ঢালাও মামলা হওয়ার কারণে আসল অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছেন উল্লেখ করে আনু মুহাম্মদ বলেন, “কিছুদিন আগে বড় বড় অপরাধীদের বেশ কয়েকজন ছাড়া পেয়ে গেল। আমি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রভাবশালী একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, এত বড় বড় অপরাধী ছাড়া কীভাবে পাচ্ছে? তিনি উত্তর দিলেন ‘আমি কিছু জানি না।’ তাহলে কারা জানে? সেটাও তিনি জানেন না। তাহলে সিদ্ধান্ত কীভাবে হচ্ছে? একদিকে দেখতে পাচ্ছি বড় বড় অপরাধী ছাড়া পাচ্ছে, অপরাধীরা দেশ থেকে পালিয়ে যাচ্ছে; অন্যদিকে এমন অনেকের নামে মামলা হচ্ছে, যাতে মামলার গ্রহণযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে।”
গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা কমিটির সদস্য হিসেবে থাকা আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘আগের সরকারের সময় আদালত সরকারের নির্দেশ দ্বারা পরিচালিত হতো। আদালত বলে কিছু ছিল না। আদালত এবং বিচারপ্রক্রিয়া যদি যথাযথ না হয় তাহলে একই ঘটনা বারবার ঘটতে থাকবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরকার কথা বলছে, কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া কীভাবে হচ্ছে, এটিই আমাদের অজানা।’
সমাবেশে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের দাবি জানান আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শ্রমজীবী। তারা দেশে কাজ করছেন, বিদেশে কাজ করছেন। ঘরের শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন, বিনা মজুরিতে কাজ করছেন। তারা প্রতারিত হচ্ছেন, জুলুমের শিকার হচ্ছেন। এই যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাদের স্বার্থে যদি রাষ্ট্র না আসে, তাহলে লুটেরাদের পুনরুৎপাদন হবে। শ্রমিকদের জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ কোনো সরকারই করতে পারেনি। এই সরকার এসেই এটি করতে পারত। কিন্তু সরকার এটি বিবেচনা করেনি।”
আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, “জবাবদিহি এবং স্বচ্ছতার অভাবে গত সরকার স্বৈরাচারে পরিণত হয়েছিল। বর্তমান সরকারে এই দুটির অভাব কোনোভাবেই গ্রহণ করব না। এখানে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা থাকতে হবে। কীভাবে খুনিরা ছাড়া পেয়ে যায়, সেটির জবাবদিহি থাকতে হবে। কীভাবে মামলাগুলো যথাযথ না হয়ে পাইকারিভাবে হয়, সেটির জবাবদিহি করতে হবে। কেন নিহত ও আহত ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি হয় না, এর দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা কেন কাজ করছে না, সেটির জবাবদিহি থাকতে হবে। কী কারণে জিনিসপত্রের দাম কমছে না, কাদের কারণে কমছে না, এর জবাবদিহি করতে হবে। এই জবাবদিহি কিংবা স্বচ্ছতার জায়গাটা খুব শক্তিশালীভাবে থাকতে হবে।”
সমাবেশে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক মাহা মির্জা বলেন, “আন্দোলনে অংশ নেওয়া জনতার একটি বড় অংশ কিন্তু মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত কিংবা ঢাকাবাসীর ধনীরা ছিল না। বড় অংশ ছিল শ্রমজীবী মানুষ, শ্রমিক, হকার, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, ছোট দোকানদার, ছোট ব্যবসায়ী। অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষ রাস্তায় নেমেছেন, জীবন দিয়েছেন। ছাত্র, জনতা এবং শ্রমজীবী মানুষ এক হয়ে লড়াইটা করেছিলেন। ছাত্র-জনতা এক না হলে প্রতাপশালী স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হতো না।
উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক গবেষক মাহা মির্জা আরও বলেন, ‘হতাশার সঙ্গে বলতে হচ্ছে এই যে নতুন বাংলাদেশ আমরা বলছি, স্বাধীন বাংলাদেশ আমরা বলছি, তা আসলে কতটুকু নতুন? শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর নতুন সরকার গঠনের পরে আমরা নতুন কী পেলাম? আদৌ নতুন কিছু পেলাম কি না, এই প্রশ্নটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে সরকার আসে সরকার যায়; কিন্তু নিম্নবিত্ত মানুষ, দরিদ্র মানুষ এবং শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্যের কেন পরিবর্তন হয় না? সরকার পরিবর্তনের পরে নতুন আশার সঞ্চার হয়, কিন্তু শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না।’
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা অধিকার রক্ষা পরিষদের আহ্বায়ক আসমা আক্তার। সংগঠনটির সদস্য ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ওমর সমুদ্রের সঞ্চালনায় এতে আরও বক্তব্য দেন সংগঠনটির উপদেষ্টা অধ্যাপক তাহুরিন সবুর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক জি এইচ হাবীব, কবি ও সাংবাদিক আহমেদ মুনির, আন্দোলনে চোখ হারানো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ শুভ, গৃহকর্মী নূপুর বেগম প্রমুখ।
সমাবেশে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার, আর্থিক সহযোগিতা ও আহত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসন, সরকারি খাসজমি উদ্ধার করে ভূমিহীনদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা, গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা ঘোষণা, গৃহকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়াসহ ১০ দফা দাবি জানায় আয়োজক সংগঠন।
                
              
																                  
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    




































