গ্রামীণ নারীদের আলোর পথ দেখাচ্ছে ‘তথ্য আপা’


সুজন সেন, শেরপুর
প্রকাশিত: আগস্ট ২, ২০২১, ০১:৩৯ পিএম
গ্রামীণ নারীদের আলোর পথ দেখাচ্ছে ‘তথ্য আপা’

শেরপুরের পাঁচ উপজেলার গ্রামীণ নারীদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা, বাল্যবিবাহ, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, চাকরিসংক্রান্ত তথ্য, আইনগত সমস্যা এবং ডিজিটাল নানা সেবা দিয়ে লাখো নারীকে আলোর পথ দেখাচ্ছে ‘তথ্য আপা’। শুধু তা-ই নয়, করোনাকালীন দুস্থ ও অসহায় মানুষের কাছে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার কাজও করেন ‘তথ্য আপা’ প্রকল্পে কর্মরত কর্মীরা। উপকারভোগীরা বলছেন, তথ্যপ্রযুক্তি বিস্তারের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করে সমাজে জেন্ডার বৈষম্যের অন্তরায় দূর করার এটি সরকারের একটি অনন্য উদ্যোগ। 

জাতীয় মহিলা সংস্থা জেলা শাখা কার্যালয়, ‘তথ্য আপা’ প্রকল্প কার্যালয় এবং অন্যান্য একাধিক সূত্র জানায়, ‘শেখ হাসিনার বারতা, নারী-পুরুষ সমতা’, ‘নারী-পুরুষ সমতায় তথ্য আপা পথ দেখায়’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে ডিজিটাল দেশ গড়ার লক্ষ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়ন প্রকল্পটি (দ্বিতীয় পর্যায়) শেরপুর সদর উপজেলাসহ নকলা, নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নকলায় চলমান রয়েছে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে জাতীয় মহিলা সংস্থা। 

প্রকল্পটি একযোগে ৮টি বিভাগের ৬৪ জেলার ৪৯০টি উপজেলায় কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ওই সব উপজেলার প্রতিটিতে প্রকল্পের আওতায় একটি করে তথ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রতিটি তথ্যকেন্দ্রে একজন তথ্য সেবা কর্মকর্তা ও দুইজন তথ্য সেবা সহকারী তথ্য সেবা প্রদানের কাজে নিয়োজিত আছেন। তারাই প্রকল্প এলাকায় ‘তথ্য আপা’ হিসেবে পরিচিত। সরকারের রূপকল্প-২০২১, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১৬-২০২০) এবং এসডিজির লক্ষ্যমাত্রায় নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়। দেশের গ্রামের অসহায়, দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত কিংবা কম সুবিধাপ্রাপ্ত নারীর তথ্যে প্রবেশাধিকার এবং তাদের তথ্য প্রযুক্তির সেবা প্রদানের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নকে ত্বরান্বিত করেছে। এ লক্ষ্যে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক ডিজিটাল দেশ গড়ার লক্ষ্যে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়ন শীর্ষক প্রকল্পটি গৃহীত হয়। প্রকল্পটি প্রথম পর্যায়ে ১৩টি উপজেলায় সফলভাবে বাস্তবায়ন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় তথ্যপ্রযুক্তির সহজলভ্যতা ৪৯০টি উপজেলায় তৃণমূল নারীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে পাঁচ বছর মেয়াদি (এপ্রিল ২০১৭ থেকে মার্চ ২০২২ পর্যন্ত) ‘তথ্য আপা’ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

প্রকল্পের মোট জনবল ১ হাজার ৯৭৮ জন। ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে ১৮ জন এবং ৪৯০টি তথ্যকেন্দ্রে ১ হাজার ৯৬০ জন কর্মরত। এর প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৪৪ কোটি ৯০ লাখ ৭৪ হাজার টাকা।

উপকারভোগী সদর উপজেলার জঙ্গলদী গ্রামের রৌশনারা, কুমরী কাটাজান গ্রামের পারভীন ও চান্দেরনগর গ্রামের মনোহার বলেন, তথ্যকেন্দ্রে কর্মরত তথ্য আপারা উঠান বৈঠকে উপস্থিত গ্রামীণ নারীদের ইন্টারনেটের বাস্তব ব্যবহারের মাধ্যমে সেবাপ্রাপ্তির পদ্ধতি প্রদর্শন করেন। এ ছাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, কৃষি কর্মকর্তা, মৎস্য কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, সরকারি আইটি বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন বিষয়ে রিসোর্স পারসন হিসেবে উপস্থিত থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মুক্ত আলোচনা করেন। 

নালিতাবাড়ীর গোজাকুড়া গ্রামের রিতা আক্তার, পূর্ব কাপাশিয়া গ্রামের সালমা বেগম ও গোল্লারপাড় গ্রামের ইরানী বেগম বলেন, প্রতিটি উঠান বৈঠকে ১০০ জন নারী অংশগ্রহণ করেন। মাসে প্রতিটি তথ্যকেন্দ্রে ২টি করে উঠান বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। গ্রামীণ নারীদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা, বাল্যবিবাহ, ফতোয়া, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, চাকরিসংক্রান্ত তথ্য, আইনগত সমস্যা এবং বিদেশে থাকা আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে ই-মেইলে তথ্য আদান-প্রদান, ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কথা বলার পদ্ধতি শিখিয়ে দেওয়া সম্পর্কিত সেবা দিয়ে লাখো নারীকে আলোর পথ দেখাচ্ছেন তথ্য আপারা। 

তথ্য আপা কেন্দ্রের সদর উপজেলা শাখার কর্মকর্তা সেতু রানী সূত্রধর বলেন, তথ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীদের ব্লাড প্রেশার পরীক্ষা, ওজন পরিমাপ ও ডায়াবেটিস পরীক্ষা এসব প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বিনা মূল্যে প্রদান করা হয়। অত্যন্ত সহজ পন্থায় বলতে গেলে ওই সব সেবার পাশাপাশি নিখরচায় তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা গ্রহণ করে নারীর ভাগ্যবদলের দিকনির্দেশনা রয়েছে ‘তথ্য আপা’ উদ্যোগে।

সেতু রানী সূত্রধর জানান, বর্তমান করোনা পরিস্থিতির কারণে সরকারি নির্দেশনায় অফিস বন্ধ রয়েছে। পরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দিকনির্দেশনা মোতাবেক সেবা প্রদান আবারও শুরু হবে।

জাতীয় মহিলা সংস্থার জেলা কর্মকর্তা আসলামউদ্দীন বলেন, মাইন্ড ইন্সপায়ার টু ন্যাশনাল অ্যাচিভমেন্ট এবং সেলফ হেল্প গ্রুপের সদস্যদেরকে টেক্সটুয়াল, অডিও, ভিডিও কনটেন্টের মাধ্যমে ই-লার্নিং প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। যার ফলে গ্রামীণ নারীদের আইটিইএস দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। ই-লার্নিং সিস্টেমে লাইভ ক্লাস, লাইভ ব্রডকাস্ট বক্তৃতা, পূর্বনির্ধারিত অনলাইন শ্রেণিকক্ষ, ২৪ ঘণ্টা ই-লার্নিং চ্যানেল, ভিডিও গ্যালারি, মোবাইল টিভি, লাইভ স্ট্রিমিং ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য অন্তর্ভুক্ত থাকছে। মোট কথা, তথ্য আপা প্রকল্প একটি ডিজিটাল প্রতিচ্ছবি।

জাতীয় মহিলা সংস্থার জেলা চেয়ারম্যান নাসরিন বেগম ফাতেমা বলেন, প্রতিটি তথ্যকেন্দ্রে নিয়োজিত তথ্যসেবা কর্মকর্তা ও তথ্যসেবা সহকারীরা সংশ্লিষ্ট উপজেলার গ্রামীণ নারীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ল্যাপটপ ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন, ব্যবসা, জেন্ডার এবং কৃষিবিষয়ক বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করছেন। এ ছাড়া স্কাইপের মাধ্যমে উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং উপজেলার সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সেবাগ্রহীতার কথোপকথনের মাধ্যমে সমস্যার দ্রুত ও কার্যকরী সমাধানে সহায়তা করছেন।

নাসরিন বেগম ফাতেমা আরও জানান, গ্রামীণ ও উপশহরাঞ্চলের নারীরাই তথ্যভান্ডারের প্রধান সুবিধাভোগী। তবে তথ্যভান্ডারের সেবাগ্রহীতা হতে পারেন শিক্ষাবিদ, গবেষক, নীতিনির্ধারক এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞ নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ।

জেলা মহিলা ও শিশুবিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ের উপপরিচালক লুৎফর কবির বলেন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনামতো তথ্য আপা প্রকল্পটি ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। আর এটি বাস্তবায়নে জেলার পাঁচ উপজেলার ইউএনও প্রত্যক্ষভাবে তদারকি করছেন। 

প্রকল্প অফিস ও মাঠপর্যায়ে সভা, অনুষ্ঠান আয়োজনের তথ্য সংরক্ষণ, উপকারভোগীদের তালিকা সংরক্ষণ, তাদের সেবা প্রদান, সেবা প্রদানকালে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান করার মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে কাজ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সদর উপজেলা ইউএনও ফিরোজ আল মামুন।
 

Link copied!