কান ডায়েরি-৫

টি-শার্টে ‍‍`প্যারিস‍‍`, টুপিতে ‍‍`১৬১৯‍‍`


পার্থ সনজয়
প্রকাশিত: আগস্ট ১৯, ২০২১, ০৩:২০ পিএম
টি-শার্টে ‍‍`প্যারিস‍‍`, টুপিতে ‍‍`১৬১৯‍‍`

‘ওয়ার্ল্ডস পারফিউম ক্যাপিটাল’, 'গ্রাসে' শহরটার পরিচয় এমনই। সেই শহরটাকে পাশে রেখেই সেজান ভাইয়ের গাড়িটা ছুটছিল। পাইন, জলপাই আর সাইপ্রাস গাছে ঘেরা যে উচুঁ পাহাড়ি ‘গ্রাম’টায় আমরা পৌঁছালাম, তাই ‘মোজা’। 

পাবলো পিকাসোর শেষ দিনগুলোর স্মৃতিমাখা এই গ্রাম প্রতিবছর আয়োজন করে থাকে ‘ইন্টারন্যাশনাল গ্যাস্ট্রোনমি ফ্যাস্টিভাল অব মোজা’। রসনার জন্য বিখ্যাত ‘মোজা’ গ্রামটি বিশ্বখ্যাত রন্ধন শিল্পীদের জন্যও।   

তাই শুধু পিকাসোর ভাস্কর্য নয়, ‘মোজা’র পথের বাঁকে শোভা পায় সেইসব রন্ধনবিদদেরও ভাস্কর্য।

সেই রসনার সাম্রাজ্যে, বাংলাদেশী সেজান চৌধুরীর রেস্টুরেন্ট ‘কারি হাউস’ যেন ছড়িয়ে দিয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের রসনা সংস্কৃতি। সেই গল্প আরেক দিন! 

কারি হাউসেরই ওপরে থাকার ব্যবস্থা আমাদের। রুমে শাওয়ার শেষে ক্লান্ত শরীরটা আশ্রয় নিল বিছানায়। ঘুম ভাঙ্গলো রাতে ডিনারের ডাকে। ততক্ষণে বিদায় নিয়েছে রেস্টুরেন্টের যাবতীয় ব্যস্ততা। ডিনার টেবিলে সেজান ভাই, সাবরীনা ভাবী আর জনির সাথে ‘ছোট্ট মিমোসা’র খুনসুটিসহ দারুণ গল্পে রাত গভীর।

সকালে সেজান ভাইয়ের গাড়িতেই আমরা ছুটলাম কানে। শুরু হলো আমাদের ‘কান মিশন’।

‘পালে দো ফেস্টিভ্যাল’ অ্যারেনায় পৌঁছাতেই ওপেন করলাম ক্যামেরা। ভবনের তিনটি অংশেরই বহির্ভাগে নজর কাড়ছে সুবিশাল তিনটি অফিসিয়াল পোস্টার। 

‘জিভি’ ছবি নিয়ে দাঁড়ালাম কিউতে। ‘এন্টি কোভিড’ অ্যাপসে থাকা পিসিআর রিপোর্ট, আইডি কার্ড স্ক্যান শেষে সিকিউরিটি চেক পেরিয়ে চলে এলাম নীচতলায়। সংগ্রহ করে নিলাম মেরুন রঙের ‘সৌজন্য ব্যাগ’।

অন্যান্যবার এই ব্যাগে থাকতো উৎসব নিয়ে যাবতীয় তথ্য, ছবিসহ বুকলেট, লিফলেট আর স্যুভেনির। এবার শুধুই ব্যাগ। আর তাতে গোটা দুইখান লিফলেট। কারণ, এবার উৎসব কমিটি পরিবেশ সচেতনতায় বৃক্ষ নিধন হ্রাসে ছাপা কাগজের ব্যবহার কমিয়ে এনেছে ৫০ শতাংশ। পরিবর্তে সবতথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে।

৭২ তম কান আসরে ২২ হাজারের বেশী প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার হয়েছিল। এবার তা নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। দোতলার ‘প্রেস রুম’, চার তলায় সাংবাদিকদের জন্য ‘তেরাজ’-কোনখানেই প্লাস্টিকের ব্যবহার নেই। পানীয় পানের জন্য ব্যবহৃত ‘গ্লাস’, ‘স্ট্র’-সবই কাগজে তৈরি। 

এমনকি অর্ধেক দৈর্ঘ্যে নামিয়ে আনা লাল গালিচা তৈরি হয়েছে পুনঃব্যবহৃত বস্তু দিয়ে। ‘ভিলেজ ইন্টারন্যাশনাল’সহ উৎসবে কার্পেটের ব্যবহার এক চতুর্থাংশ কমিয়ে আনা হয়েছে। উৎসবে তারকাদের জন্য ব্যবহৃত গাড়ির ৬০ শতাংশই এবার বিদ্যুৎচালিত। সবমিলিয়ে পরিবেশবান্ধব উৎসব করতে কর্তৃপক্ষ পরামর্শ নিয়েছে পরিবেশবাদী সংস্থা ‘গ্রিন এভেনম্যঁ’র। যুক্ত করেছে ‘সিনেমা ফর দ্য ক্লাইমেট’ বিভাগ। যাতে রয়েছে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্যসহ ছয়টি প্রামাণ্যচিত্র।   

করোনার কথা মাথায় রেখে এবারের প্রেস জোনে রাখা হয় নি কোন কম্পিউটার। সাংবাদিকরা সবাই যার যার ল্যাপটপেই কাজ সারছেন। 

উদ্বোধনী দিন। তাই প্রায় ফাঁকা প্রেস জোন। অপেক্ষা সন্ধ্যার। তবে দুপুরে সংবাদ সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকের উপচে পরা ভিড়। 

সংবাদ সম্মেলন শেষে হেঁটে যাচ্ছেন প্রধান বিচারক স্পাইক লি ও স্পাইক লি'র নেতৃত্বে 'জুরি প্যানেল'

কানের ৭৪ বছরের ইতিহাসে এবারই প্রথম কোন কৃষ্ণাঙ্গ পরিচালক স্পাইক লি নেতৃত্ব দিচ্ছেন ‘জুরি প্যানেলে’র। মার্কিন এই পরিচালকের নেতৃত্বে সেই কক্ষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন মূল প্রতিযোগিতা বিভাগের সব বিচারক। 

তবে সবার আগ্রহের কেন্দ্রে স্পাইক লি! তার টি-শার্ট জুড়ে লেখা ‘প্যারিস’ আর মাথার টুপিতে লেখা চার অংকের সংখ্যা ‘১৬১৯’। পেছনের কারণটা জানতে ফিরতে হবে ইতিহাসে।

ইংরেজি ১৬১৯ সালেই ভার্জিনিয়ার ইংরেজি কলোনিতে পৌঁছায় ২০ আফ্রিকানকে নিয়ে একটি জাহাজ। মনে করা হয়, এই আফ্রিকানদের দিয়েই শুরু হয় আমেরিকায় দাসপ্রথা।

সংবাদ সম্মেলন জুড়ে উঠে আসে চলচ্চিত্রে বর্ণবাদের প্রভাব, এলজিবিটি ইস্যু, নেটফ্লিক্সসহ নানা বিষয়। এবারের উৎসবে আট বিচারকের পাঁচজনই নারী। রয়েছেন মাতি দিওপ, কানাডিয়ান-ফরাসি সংগীতশিল্পী মিলেন ফারমা, আমেরিকান অভিনেত্রী ম্যাগি জিলেনহাল, অস্ট্রিয়ার পরিচালক জেসিকা হাউসনা, ফরাসি অভিনেত্রী মেলানি ল্যঁহো।  বাকীরা হলেন ব্রাজিলিয়ান পরিচালক ক্লেবার মেনদোনচা ফিলো, ফরাসি অভিনেতা তাহের রহিম এবং দক্ষিণ কোরিয়ার অভিনেতা সঙ কাঙ-হো। 

সংবাদ সম্মেলনে কথা হলো, হলো ছবি তোলা। তবু প্রেস জোন ছেড়ে 'টিম স্পাইক লি' বেরিয়ে যাবার পথে দুই সারিতে দাঁড়িয়ে আলোকচিত্রী আর অটোগ্রাফ শিকারীরা। কারো দিকে তাকিয়ে হাসি, কারো সাথে একটা সেলফি। সাথে ক্যামেরার অজস্র ক্লিক। 

সংবাদ সম্মেলন কাভার করে প্রেস জোনে যখন সংবাদ তৈরিতে ব্যস্ত তখনই উৎসব চত্বর আবারো মুখর হলো লাল গালিচার রোমাঞ্চে। দুই বছর পর পুনর্মিলন ঘটলো অভিনেতা, পরিচালক, বিচারক, সংবাদকর্মীসহ চলচ্চিত্রপ্রেমীর!

এবার হাতছানি সন্ধ্যার গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়েরে জমকালো উদ্বোধনীর!

 

(চলবে)

প্রেস জোনে আমরা

 

 

Link copied!