• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫

নীরবতা আসলে অত্যাচারকে গভীরতর করে


ফরিদ আহমেদ
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২২, ০৭:৩৫ পিএম
নীরবতা আসলে অত্যাচারকে গভীরতর করে

মেয়েটার নাম মাসা আমিনি। মাত্র বাইশ বছর বয়স তার। তেহরান থেকে বহু দূরে পশ্চিম ইরানে বসবাস করতো। তেহরানের আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল সে। সেটাই কাল হয়েছিল তার। তার পোশাক ঠিক নেই, হিজাবের ফাঁক দিয়ে চুল দেখা গেছে, এই ‘গুরুতর’ অজুহাতে তেহরানের রাস্তা থেকে মোরালিটি পুলিশ ধরে নিয়ে যায় তাকে। মাসার সাথে থাকা তার ছোট ভাই অনুনয় বিনয় করেছিল এই বলে যে, আমরা তেহরানে থাকি না, এখানকার নিয়ম-কানুন জানি না, কাউকে চিনিও না, আমার বোনকে ছেড়ে দেন আপনারা। মোরালিটি পুলিশ বাচ্চা ছেলেটার কথায় কর্ণপাত করেনি। তাকে মারধোর করে, ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে মাসাকে নিয়ে ভ্যানে তোলে তারা। সেখান থেকে মারধোর করা শুরু হয় তাকে। নিয়ে যাওয়া হয় ‘এডুকেশন এন্ড এডভাইস’ সেন্টারে। এই শিক্ষা এবং পরামর্শ কেন্দ্রে নিয়ে শিক্ষা দেওয়া হয় মেয়েদের। সেই শিক্ষা দেওয়া পাঠ্য বইয়ের মাধ্যমে না, পিটানোর মাধ্যমে দেওয়া হয়।

এখানে নিয়ে গিয়ে মাসাকেও নির্মমভাবে পিটিয়েছে ধর্ম পুলিশেরা। ধরে নিয়ে যাওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তার পরিবার জানতে পারে যে মাসা কোমাতে চলে গিয়েছে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। সেখানেই মারা যায় ফুটফুটে এই মেয়েটা। জীবন যার মাত্র শুরু হতে যাচ্ছিল, বসন্তের বাতাস বইছিল জীবনে, ঠিক সেই সময়ে হিংস্র একদল মূর্খ ধর্মরক্ষকদের পাল্লায় পড়ে জীবন হারায় সে। পুলিশের অত্যাচারে মাসা মারা গিয়েছে এটা তারা স্বীকার করে না। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, মাসা হার্ট এটাকে মারা গিয়েছে, তাদের কোনো দোষ নেই। অন্যদিকে তার পরিবারের দাবি হচ্ছে, মাসার কোনো শারীরিক সমস্যা ছিল না।

হিজাব নিয়ে এই কড়াকড়ি এবং নির্মমতা ইরানে নতুন কিছু নয়। ১৯৭৯ সালে ইরানে যে বিপ্লব ঘটেছিল, সেই বিপ্লবের পর থেকেই মেয়েদের পোশাকের ওপর কঠোর বিধি নিষেধ আরোপিত হয়। না মানলেই তুমুল অত্যাচার নেমে এসেছে মেয়েদের ওপরে।

মাসার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অনেকটা বিনা প্রতিবাদেই ইরানের মানুষেরা মেনে নিচ্ছিল এই অত্যাচার। অনেকের ধারণা থাকে নীরব থাকলে তার ওপরে বিপদ আসবে না। এই ধারণাটা প্রচণ্ড রকমের ভুল একটা ধারণা। নীরবতা আসলে অত্যাচারকে গভীরতর করে, অত্যাচারীর সময়কালকে দীর্ঘস্থায়িত্ব দেয়। প্রতিবাদ করলে বিপদের ঝুঁকি থাকে, সেটা সত্যি কথা। কিন্তু, এটাও সত্যি যে, সম্মিলিত প্রতিবাদ হলে অত্যাচারী ভয় পায়, অত্যাচার করার ক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার চিন্তা করে সে। যে কারণে নীরব থাকা শুধু নিজেকে বাঁচানোর পর্যায়ে পড়ে না, অত্যাচারীর হাতকেও শক্তিশালী করার দায়ে অভিযুক্ত হয়। আমরাও একই অপরাধের অংশ হয়ে পড়ি।

ইরানের একজন বিখ্যাত চিত্রপরিচালক আসগর ফরিদী যেমন লিখেছেন, “We are pretending to be asleep at the face of this never-ending oppression. We are all partners in this crime.”
মাসার মৃত্যু অবশ্য অনেককে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিয়েছে। ইরানের মেয়েরা ঘর ছেড়ে বাইরে বের হয়ে এসেছে। রাস্তায় মিছিল করে তারা প্রতিবাদ জানাচ্ছে। হিজাব পুড়িয়ে হিজাবের মৃত্যু ঘণ্টা জানান দিচ্ছে তারা। অনেকেই তীব্র ক্ষোভে চুল কেটে ফেলছে। সেই চুল কাটার দৃশ্য সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করছে তারা। কাটা চুল দিয়ে পাতাকা বানিয়ে সেই পতাকাকে ওড়াচ্ছে তারা। সহজ ভাষায়, মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমে গিয়েছে ইরানের মেয়েরা। সেই লড়াইয়ে মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে তারা এই মুহূর্তেই জয়ী হবে কিনা, সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে, একদিন যে তারা মোল্লাতন্ত্রের হাতের মুঠো থেকে বের হয়ে নিজেদের স্বাধীন জীবন ফিরে পাবে, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই আমার। কোনো অত্যাচারীই চিরকাল অত্যাচার চালিয়ে যেতে পারে না। একদিন না একদিন তার পতন ঘটেই।

কর্তিত কুন্তলের কেতন উড়িয়ে ইরানের মেয়েরা মৌলবাদের সেই পতনের  চিহ্নই দেখাচ্ছে আমাদের।

 

লেখক : প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, সমাজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Link copied!