আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার অজুহাতে গত ৪ নভেম্বর সরকার ডিজেল ও কেরোসিনে দাম এক লাফে ২৩ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। এরপর আবার আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও তার প্রভাব দেশের বাজারে পড়তে দেয়নি সরকার। জ্বালানী তেলের দাম বাড়লে বাসের ভাড়া বাড়বে, এটা প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু পরিবহণ মালিকদের তর সয়নি। তারা ৫ নভেম্বর শুক্রবার থেকেই সারাদেশে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। টানা তিনদিন গোটা জাতিকে জিম্মি করে জ্বালানী তেলের দাম ২৩ শতাংশ বাড়লেও ভাড়া বাড়ে ২৭ শতংশ। মালিকদের ব্ল্যাকমেইল শেষ হলে মাঠে নামে শ্রমিকরা। তারা মালিকদের সিদ্ধান্ত না মেনে সিটিং সার্ভিস অব্যাহত রাখে। কারণ সিটিং সার্ভিস, নগরবাসী যেটাকে ‘চিটিং সার্ভিস’ বলে, তার অজুহাতে আগে থেকেই বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছিল। এখন সিটিং সার্ভিস না থাকলে অনেক বাসের ভাড়া কমে যাবে। শ্রমিকরা আগের মত নিজেদের ইচ্ছামত বাড়তি ভাড়াই আদায় করতে থাকে। ভাড়া বাড়িয়েই যেন সরকারের দায়িত্ব শেষ। সেটা ঠিকমত কার্যকর হচ্ছে কিনা, তা দেখার কেউ নেই। বিআরটিএ নামেমাত্র মোবাইল কোর্ট বসালেও তা কোনো কাজে আসেনি। ডিজেলের দাম বাড়লেও ভাড়া বাড়ে সব বাসেরই। এতদিন জানতাম রাজধানীর ৯৫ ভাগ সিএনজিচালিত। এখন শুনি, ২/৩ ভাগ গাড়ি নাকি সিএনজিতে চলে। সিএনজিচালিত গাড়ি রাতারাতি কিভাবে ডিজেলচালিত হয়ে গেল সেটা এক রহস্য বটে। তারমানে সড়কে যে নৈরাজ্য চলছিল, মালিক-শ্রমিক চক্রের যে দৌড়াত্ম্য, তাই বজায় থাকলো।
মালিক-শ্রমিকদের নৈরাজ্য শেষে মাঠে নামে শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি যৌক্তিক। গণপরিবহণে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। কিন্তু এখন ঢাকার অনেক বাসের গেটে লেখা থাকে ‘হাফ পাশ নাই’। হাফ ভাড়া নিয়ে শ্রমিকদের সাথে শিক্ষার্থীদের নিত্য লড়াই। এ লড়াই থামাতেই মাঠে নামে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার আন্দোলনে নতুন মাত্রা যুক্ত হয় ২৪ নভেম্বর নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসানের মৃত্যুতে। হাফ ভাড়ার চেয়ে বড় হয়ে আসে নিরাপদ সড়কের দাবি। ২৯ নভেম্বর রামপুরায় শিক্ষার্থী মাইনুদ্দিনের মৃত্যু আন্দোলনের আগুনে ঘি ঢালে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা প্রতিদিনই নানা কর্মসূচি পালন করছে। পরিবহন মালিকদের অন্যায্য দাবি মানতে সরকারের লেগেছে মাত্র ৩ দিন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি নিয়ে সরকারের যেন কোনো মাথাব্যথাই নেই। করোনায় দেড় বছরেরও বেশি ক্লাশের বাইরে থাকা শিক্ষার্থীরা প্রায় ২০ দিন ধরে রাস্তায়, অথচ সরকারের কেউ তাদের মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে বলছে না, তোমরা ক্লাশে ফিরে যাও, সড়ক নিরাপদ করতে আমরা আন্তরিক চেষ্টা করবো।
নিরাপদ সড়কের দাবি নতুন নয়। সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চনের মৃত্যুর পর চলচ্চিত্রের ঝলমলে জগত ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসেন জনপ্রিয় চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। গত ২৮ বছর ধরে তিনি ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ এই ব্যানারে আন্দোলন করে আসছেন। সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরের মৃত্যুর পর দেশজুড়ে নিরাপদ সড়কের দাবিতে প্রবল জনমত গড়ে ওঠে। ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে দুই বাসের সংঘর্ষে রমিজউদ্দিন কলেজেন দুই শিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়ার মৃতুর পর শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশজুড়ে নজিরবিহীন এক আন্দোলন শুরু করে। ছোট শিক্ষার্থীরা বড়দের শিখিয়ে দেয় কিভাবে আন্দোলন করতে হয়, কিভাবে সড়ক নিরাপদ রাখতে হয়। কিন্তু আমরা কিছুই শিখিনি। অহিংস শিক্ষার্থীদের রাস্তা থেকে সরাতে মাঠে নামানো হয় সহিংস হেলমেট বাহিনীকে। তবে শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে সড়ক নিরাপদ করতে সংসদে কঠোর আইন প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীরা ক্লাশে ফিরে যেতেই সেই আইন ফ্রিজে চলে যায়। শিক্ষার্থীদের চেয়ে পরিবহন দুর্বৃত্তদের ক্ষমতা যে বেশি। বাংলাদেশে প্রতিদিন দুর্ঘটনায় মানুষ মৃত্যুর খবর আসে পত্রিকায়। কিন্তু গাড়ি চাপা দিয়ে মানুষ হত্যার বিচারের কয়টি খবর আসে? তার মানে মানুষ হত্যার বিচার হয় না।
২০১৮ সালের মত তীব্র না হলেও শিক্ষার্থীরা প্রায় ২০ দিন ধরে রাস্তায় আছে। সরকারের কেউ তাদের পাশে দাঁড়ায়নি। সহপাঠীর মৃত্যুতে বেদনার ক্ষতে প্রলেপ বোলানোর কোনো চেষ্টা নেই। শিক্ষার্থীরা তো অযৌক্তিক কোনো দাবিতে আন্দোলন করছে না, বা তারা প্রচলিত আন্দোলনের মত রাস্তায় অরাজকতাও করছে না। তারা শুধু নিরাপদ সড়ক চায়। শুধু এ বছরের প্রথম ১১ মাসে ৭৩৭ জন শিক্ষার্থী সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে, যে মাসে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে, সেই নভেম্বর মাসেও মারা গেছে ৫৪ জন। একের পর এক সহপাঠী মারা গেলে সচেতন শিক্ষার্থীরা তো আন্দোলন করবেই। আমি বলছি না, সরকার চাইলেই রাতারাতি সড়ক নিরাপদ হয়ে যাবে। কিন্তু সরকার তার সদিচ্ছার প্রমাণ দিতে পারে। আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পারে। তার কোনো প্রমাণ নেই। সরকার ব্যস্ত আন্দোলনে বহিরাগত আর উস্কানি খুঁজতে। নিরাপদ সড়কের দাবি তো শুধু শিক্ষার্থীদের নয়, এটা সবার দাবি। এ আন্দোলনের জন্য কারো উস্কানি লাগে না। এ বছরের প্রথম ১১ মাসে ৪ হাজার ২৬৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ১৪৪ জন মারা গেছেন। তাহলে তো দেশের সবারই রাস্তায় নামা উচিত। শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছে, তাদের ধন্যবাদ। আমরা যারা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে বহিরাগত আর উস্কানি খুঁজছি, আমরাই বরং নিজের বিবেকের কাছে অপরাধী। এ আন্দোলনে বহিরাগত বলে কেউ নেই। সবারই নিরাপদ সড়কের দাবি জানানো উচিত।
২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় আমরা সবাই বলেছিলাম, শিক্ষার্থীরা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। কিন্তু ৩ বছর পরে এসে বলতেই হয়, শিক্ষার্থীরা আমাদের চোখ খুলে দিলেও তারা ক্লাশে ফেরার সাথে সাথে আমরা আবার চোখ বন্ধ করে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছি। রাস্তায় সেই নৈরাজ্য, সেই মৃত্যুর মিছিল চলছেই। এভাবেই কি চলবে? আমাদের সড়ক কবে নিরাপদ হবে?
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট