• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২১ মে, ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১,

হিরো আলমকে কারা ‘হিরো’ বানাতে চায়


প্রভাষ আমিন
প্রকাশিত: জুলাই ১৭, ২০২৩, ১০:৩৩ পিএম
হিরো আলমকে কারা ‘হিরো’ বানাতে চায়

কয়েক মাসের জন্য কে ঢাকা-১৭ আসনের এমপি হবেন, তা নিয়ে খুব বেশি কৌতুহল ছিলো না কারোই। একতরফা নির্বাচন নিয়েও সঙ্গত কারণে কারো আগ্রহ ছিলো না। রাজধানীর অভিজাত গুলশান-বনানী এলাকার এই আসনের নির্বাচন নিয়ে যেটুকু আলোচনা, তা স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলমের কারণেই। হিরো আলম নামে পরিচিত এই প্রার্থী নিয়ে আলোচনা শুধু ঢাকা-১৭ আসনে নয়, দেশজুড়ে।

বগুড়ার গ্রামের একসময়কার ডিশ ব্যবসায়ী আশরাফুল আলমের হিরো হওয়ার খুব শখ ছিলো। এমন শখ অনেকেরই থাকে। কিন্তু আশরাফুল আলম শখপূরণ করার উপায় বের করেন। স্থানীয়ভাবে মিউজিক ভিডিও বানিয়ে তা নিজের ডিশ নেটওয়ার্কে প্রচার করতেন। এভাবেই তিনি স্থানীয়ভাবে ‘হিরো আলম’ নামে পরিচিতি পান। সেই মিউজিক ভিডিও ইউটিউবে ছাড়ার পর দ্রুতই তিনি ভাইরাল হয়ে যান। দেশজুড়ে তাকে নিয়ে ব্যাপক কৌতুহল তৈরি হয়। ইউটিউবে বিপুলসংখ্যক মানুষ ‘হিরো আলম’ নামে সার্চ শুরু করেন। দ্রুতই তারকাখ্যাতি পেয়ে যান তিনি। একের পর এক মিউজিক ভিডিও, নাটক, সিনেমা বানিয়ে আলোচনায় থাকেন তিনি। এক পর্যায়ে শুরু করেন বেসুরো গলায় গান গাওয়া। ভুল সুরে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে পুলিশের কাছ থেকে সতর্কবার্তাও পেয়েছেন তিনি। লিখেছেন বইও। কিন্তু তাতেই থেমে থাকেননি হিরো আলম।
শুধু বাংলাদেশ নয়, অনলাইনে বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশী, এমনকি বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে পরিচিতি পান তিনি। তার কর্মকাণ্ডের বিপুল দর্শক যেমন আছে, আছে বিপুল সমালোচকও। কিন্তু কোনো বাধা বা সমালোচনাই দমাতে পারেনি তাকে। তিনি জানেন যত আলোচনা, যত সমালোচনা; ততই লাভ। দ্রুত ফুলেফেপে ওঠে তার ব্যাংক একাউন্টও।

কদিন আগে নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ হিরো আলমকে ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ বলে রীতিমত তোপের মুখে পড়েন। বিপুল সংখ্যক মানুষ হিরো আলমের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়িয়ে যান। শুধু হিরো আলম কেন, বাংলাদেশের সব মানুষেরই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে। আইনি কাঠামোর মধ্যে যে কেউ যা ইচ্ছা করতে পারেন। হিরো আলমের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি আমার পূর্ণ সমর্থন আছে। কিন্তু বিনোদনের নামে, সংস্কৃতির নামে হিরো আলম যা করেন, তাতে সত্যিই মনে হয় দেশে রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে।   

তবে বিনোদন জগতেই নিজের পদচারণা সীমাবদ্ধ রাখেননি হিরো আলম। নির্বাচনের রোগেও পেয়ে বসে তাকে। যেখানেই সুযোগ পান নির্বাচনে দাঁড়িয়ে যান তিনি। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জাতীয় সংসদ, সবখানেই নিজের ভাগ্য যাচাই করেন তিনি। বগুড়া উপনির্বাচনে মাত্র ৯০০ ভোটে হেরে গিয়ে আবারও দেশজুড়ে আলোচনার ঝড় তোলেন তিনি। চিত্রনায়ক ফারুকের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া ঢাকা-১৭ আসনেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন তিনি।

বগুড়ার মত ঢাকায়ও নির্বাচন কমিশন তার মনোনয়নপত্র বাতিল করেছিল। কিন্তু হাইকোর্টের রায় নিয়ে নির্বাচনে ফেরেন তিনি। 

বরাবরই নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী থাকেন হিরো আলম। এটা অবশ্য সব প্রার্থীই করেন। ঢাকা-১৭ আসনেও জয়ের ব্যাপারে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অনেকে হাইপ তোলেন, আওয়ামী লীগ এখন এতটাই অজনপ্রিয়, এমনকি তাদের প্রার্থী হিরো আলমের কাছেও হেরে যেতে পারে। ঢাকা-১৭ আসনে গুলশান-বনানীর মত অভিজাত এলাকা যেমন আছে, আছে কড়াইল বস্তিতে থাকা নিম্ন আয়ের মানুষেরাও। নির্বাচনে অংশ না নেয়া বিএনপি সমর্থকরাও হিরো আলমকে ভোট দিতে পারেন, এই ভরসায় হিরো আলম এগিয়ে যাচ্ছিলেন। আমার ধারণা, মুখে যাই বলুন, হিরো আলম নিজেও জানেন তিনি জিততে পারবেন না। কিন্তু সবসময় আলোচনায় থাকাটাই আসলে তার পেশা। ইউটিউবে যত ভিউ, তত আয়। আয় নিশ্চিত রাখতেই যে কোনো মূল্যে আলোচনায় থাকতে চান তিনি। 

নিরুত্তাপ, একতরফা হলেও ঢাকা-১৭ আসনে প্রার্থীরা প্রচারণা চালিয়েছেন ব্যাপকভাবে। প্রচারণাকালে একবার হিরো আলমের ওপর হামলা হওয়ার ঘটনা বাদ দিলে নির্বাচনী প্রক্রিয়া শান্তই ছিলো। সোমবার দিনভর শান্তিপূর্ণভাবেই ভোট হয়েছে। শুধু অভাব ছিলো ভোটারের। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টে যায় বিকেলে। ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার ঘণ্টাখানেক আগে বেলা তিনটার দিকে বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়েছিলেন হিরো আলম। সেখানে তিনি একটি নারী ভোটকেন্দ্রে যান। এ সময় নৌকা প্রতীকের কর্মী ও সমর্থকেরা পেছন থেকে হিরো আলমকে গালমন্দ করতে থাকেন এবং কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন। পুলিশের সামনেই তারা হিরো আলমের ওপর হামলা চালায়। পরে কেন্দ্রটির দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা হিরো আলমকে ঘিরে রেখে স্কুলের ফটকের দিকে নিয়ে যান। কিন্তু তখনো পিছু নেন হামলাকারীরা। স্কুলের প্রাঙ্গণ থেকে বেরুনোর পরে হিরো আলমের পাশে পুলিশ সদস্যরা ছিলেন না। স্কুল থেকে বের হয়ে ফটকের সামনে দিয়ে বনানী ১৬ নম্বর সড়কের দিকে দ্রুত এগোতে থাকেন হিরো আলম। একপর্যায়ে হামলাকারীরা হিরো আলমকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেন, তখন তাকে এলোপাতাড়ি মারধর করেন। হিরো আলমের সঙ্গীরা তাকে রক্ষা করে সামনের দিকে নিয়ে যান। ২৩ নম্বর সড়কের এ ব্লক পর্যন্ত তাঁকে পেছন থেকে ধাওয়া করে হামলাকারীরা। এক পর্যায়ে তিনি রিকশায়, পরে গাড়িতে উঠে এলাকা ত্যাগ করেন। নৌকার ব্যাজ লাগানো এবং জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে হামলা চালাতে আসা ব্যক্তিরা হিরো আলমের উদ্দেশে বলতে থাকেন, ‘সে করে টিকটক, সে হলো জোকার, সে কেন গুলশান-বনানীর এমপি হতে চায়? এমপির মানে সে জানে?’

হিরো আলমের এমপির মানে জানার দরকার নেই। টিকটকার হোক, জোকার হোক; বাংলাদেশের যে কোনো নাগরিকের নির্বাচন করার অধিকার আছে। জনগণ ভোট দেবে কি দেবে না; সেটা তাদের স্বাধীনতা। কিন্তু কারো ওপর হামলা করার অধিকার কারো নেই। পুলিশের উপস্থিতিতে হামলা হলেও পরে পুলিশ হামলায় জড়িত চারজনকে গ্রেফতার করেছে। জয়ী প্রার্থী মোহাম্মদ এ আরাফাত এ ঘটনাকে অনাকাঙ্ক্ষিত বলেছেন। নির্বাচন কমিশনারও হামলাকারীদের শাস্তির অঙ্গীকার করেছেন।

যারা হামলা করেছে তারা আওয়ামী লীগের কর্মী, কিন্তু কোনোভাবেই বন্ধু নয়। এই হামলায় আওয়ামী লীগের কোনো লাভ তো হয়ইনি, উল্টো ভাবমূর্তির বিশাল ক্ষতি হয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে জেতার জন্য হিরো আলমের ওপরও হামলা করতে হয়, এ দায় তাদের বহন করতেই হবে। অবশ্য মনে হয় না আওয়ামী লীগ এসব কথা বা ভাবমূর্তি নিয়ে খুব একটা ভাবে। কিন্তু ইউরোপিয় ইউনিয়নের প্রাক নির্বাচনী টিম যখন ঢাকায় ব্যস্ত সময় পার করছে, তখন এই হামলার জন্য আওয়ামী লীগকে বড় মূল্য দিতে হতে পারে। 

এর আগে ছাত্রলীগ পিটিয়ে পিটিয়ে নুরুল হক নুরকে প্রথমে ছাত্রনেতা, পরে ডাকসুর ভিপি এবং এখন জাতীয় নেতা বানিয়েছে। বনানীতে শেষ বেলার এই হামলাও ‍‍`টিকটকার, জোকার‍‍` হিরো আলমকে জাতীয় নেতা বানিয়ে দিতে পারে। হিরো আলমও এখন বলেন, আবারও প্রমাণিত হলো, এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। হিরো আলমতে যারা সত্যিকারের ‍‍`হিরো‍‍` বানাতে তাদের খুঁজে বের করে কঠোর শাস্তি দিতে না পারলে, আওয়ামী লীগের অনেক অর্জন বিসর্জনে যাবে।

লেখক : কলামিস্ট ও সাংবাদিক 

Link copied!