ইরানে পুলিশি হেফাজতে থাকা অবস্থায় ২২ বছর বয়সী কুর্দি তরুণীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে গড়ে উঠেছে বিক্ষোভ। রক্তাক্ত বিক্ষোভে উত্তাল ইরানে সাত দিনে ঝরে গেছে অর্ধশত বিক্ষোভকারীর প্রাণ। তবু কট্টরপন্থার অবসান এবং জীবন ও নারীমুক্তির দাবিতে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে দিনবদলের আহ্বান। রাষ্ট্রপ্রধানের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেই আন্দোলনকারীরা পথ দখল করে রেখেছেন। কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না বিক্ষোভকারীদের। আপাতত সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে পরিস্থিতি।
ইতোমধ্যে বিদেশি গণমাধ্যমগুলো বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করছে। কোনো কোনো বিশ্লেষক ইরানে দিনবদলের যে ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছেন, তা বাস্তব রূপ পেতে শুরু করেছে। কিন্তু এই আন্দোলন থেকে আমরা শিক্ষাও নিতে পারি। আপাতত দেশটির আন্দোলনকে নিয়ে আমাদের যা মতামত আছে, তা অনেকটাই সমাজবাস্তবতা ও বৈশ্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনার মাধ্যমে বিচার করতে হবে। ইরানে যে আন্দোলন বা বিক্ষোভ শুরু হয়েছে, তা আমাদের সংগতই এক ইতিবাচক শিক্ষা দেয়। এই শিক্ষা শুধু নারী নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সমাজের বাস্তবতা, মৌলিক অধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
বিদেশি গণমাধ্যমে যাই বলুক, রাজনৈতিকভাবে সৃষ্ট এই পরিস্থিতিতে ইরানের সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন এমনটা আশা করা সম্ভব না। তাহলে পরিবর্তন আসলে কোথায়? মূলত বহির্বিশ্বের মানুষ ইরানের সঙ্গে কিভাবে সংযুক্ত হবে তা আন্দাজ করা যায়। বিশ্বের ক্ষমতা যাদের হাতে সেই আমেরিকার বাইডেন প্রশাসন এবার ইরানের বিষয়ে কেমন নীতি নির্ধারণ করে, তা দেখার বিষয়। মূলত ইরানের পুলিশের হেফাজতে থাকা আমিনার মৃত্যুতে যে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে, এমনটা হওয়ারই ছিল। প্রতিবছর ইরানে বহু নারী হিজাব ঠিকভাবে না পরার দায়ে সহিংসতার শিকার হন। তাদের বিচার করা হয়। এমনকি ইরানে নারীদের সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, এমন কথা সম্প্রতি একটি জরিপে পাওয়া গেছে। কিন্তু জরিপ, কিংবা গণমাধ্যমে যে ইরানকে আমরা দেখেছি, বিক্ষোভের পর ইরানকে বিচার করার সময় আমরা ভিন্ন চোখে দেখতে পারব এখন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইরানে নারীর প্রতি সহিংসতার সঙ্গে ধর্মীয় কিংবা সামাজিক সংস্কৃতির প্রভাব অনেকটাই কম। কারণ ইরানের সংস্কৃতি বিচারেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নারীকে বিচারের নামে হেনস্তা ও অত্যাচারের বিষয়টি কয়েক দশকের চিত্র।
গত অর্ধশত বা ৪৩ বছর ধরেই ইরানের নারীরা প্রতিষ্ঠানের অত্যাচারের শিকার। এমনটা কেন? প্রথমে একটি বিষয় এখানে বলে নেওয়া ভালো। ইরান ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রকে সব সময় শত্রুরাষ্ট্র ভেবে এসেছে। ফলে বহু বছর ধরেই পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে ইরান এক যুদ্ধে লিপ্ত। আমরা জানি, যুদ্ধ চালানোর জন্য সামরিক শক্তিই যথেষ্ট নয়। একটি সুনির্দিষ্ট আদর্শ যুদ্ধে প্রাণ সঞ্চার করে। পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে যুদ্ধে ইরানের আদর্শগত ভিত্তির জায়গা থেকেই হিজাব বিষয়ে রক্ষণশীলতার বিষয়টি এসেছে। ইরানের সুবিখ্যাত নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খোমেনি বিশ্বাস করতেন ইরানের আদর্শগত যত ভিত্তি আছে সেগুলোতে ঢিল দেওয়া মানেই ইরান রাষ্ট্রের পতন এবং পশ্চিমা শক্তির নিকট আত্মসমর্পন। বলা বাহুল্য, এই আদর্শতে সমঝোতা না করার নীতিতে হিজাব একটি।
গত ৪৩ বছর এই ইসলামি রাষ্ট্রের ইতিহাসে বহু বিক্ষোভ হয়েছে। প্রতিটি বিক্ষোভের পেছনেই রাষ্ট্রের আগ্রাসী নীতি ও দমন-পীড়ন দায়ী। প্রতিবারই রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সহায়তায় বিক্ষোভ দমন করা হয়েছে। এবারও হয়তো সম্ভব ছিল। কিন্তু আদর্শগত ভিত্তির পাশাপাশি নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়টিকেও বিবেচনা করতে হয়। খোমেনি স্বাস্থ্যগত কারণে রাজনীতির বাইরেই বলা যায়। এমন সময় ইরানে নেতৃত্বের পালাবদলের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। ইরানের প্রতিটি অঞ্চলে ভাঙনের সুর। অবস্থা এতটাই নাজুক যে মিশর কিংবা তিউনিসিয়া থেকেও ভঙ্গুর অবস্থানে ইরান।
এমন সময়ে ইরানের এই বিক্ষোভ আমাদের রাজনীতিতে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু একে নিয়ে আশাবাদী হওয়ার তেমন সুযোগ নেই। প্রথমত, ইরানে এই বিক্ষোভের কারণে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে এমন কোনো আশা নেই। যদিও অনেকে তাই মনে করছে। কিন্তু সরকারের নিরুপায় অবস্থা দেখে এটুকু স্পষ্ট ইরানে নেতৃত্ব শূন্যতা দেখা দিয়েছে। তারপরও কিন্তু প্রাণ ঝরেছে। সামনেও হয়তো অনেকেই জীবন বিসর্জন দেবেন। কিন্তু এই বিক্ষোভে ইরানে নারীকে প্রতিষ্ঠানে যে সহিংসতা কিংবা ইরানের আদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অত্যাচারের শিকার হতো তা কিছুটা কমবে। এ ছাড়া দ্বিতীয় যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং আগেও আলোচনা করেছি, পশ্চিমা শক্তি এবার ইরান সম্পর্কে তাদের নীতি-নির্ধারণের সহজ পথ খুঁজে পাবে।
অবশ্য এই আলোচনা দেখে সরলভাবে রায় দেওয়ার সুযোগ নেই। প্রতিনিয়ত এই আন্দোলনের গতিপথ বদলাচ্ছে। নারীরা হিজাব ছাড়াই আন্দোলন করছেন। তারা নিজের চুল কেটে চিৎকার করে একনায়কের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। ইরানের জনগণের সহানুভূতিও কিছুটা জড়িয়ে পড়েছে। এতে কিছু ইরান যে ইসলামি আদর্শ প্রচার করে বেড়াচ্ছে তার প্রতি বীতশ্রদ্ধ মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এমন নেতৃত্বহীন সময়ে তা সামরিক শাসকের জন্য বাড়তি চিন্তার কারণ অবশ্যই। তবু সর্বোপরি, ইরানে এত দ্রুত গণতন্ত্রের পথ সুগম হবে না। কিন্তু ইরানের সমাজে পরিবর্তন আসবে। সেটিও ইতিবাচক এবং ইরানের জন্য স্বস্তিদায়ক। এই আন্দোলন সারা বিশ্বকেই যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে, নারী যখন আন্দোলনে নামে তখন সমাজ বদলাতে বাধ্য। তাতে আমূলে কিছু না বদলালেও দৃশ্যপটের বদল ঘটবেই।
লেখক: সংবাদকর্মী








































