• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১, ২০ মুহররম ১৪৪৫

দ্বাদশ নির্বাচনে সাত চ্যালেঞ্জে আ.লীগ


সফিকুল ইসলাম
প্রকাশিত: এপ্রিল ১০, ২০২৩, ০৯:৫৪ পিএম
দ্বাদশ নির্বাচনে সাত চ্যালেঞ্জে আ.লীগ

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সতর্কতার সঙ্গে সাত ইস্যু মোকাবিলা করাই আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছে আওয়ামী লীগের ‘থিংকট্যাংক’। এই ইস্যুগুলোর মধ্যে রয়েছে গুজব প্রতিরোধ, নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যে লাগাম টেনে ধরা, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিত করা, রাজধানীসহ সারা দেশে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা, দলের নেতাদের বিভেদ দূর করা এবং সরকারবিরোধীদের আন্দোলন কঠোরভাবে প্রতিরোধ করা। এছাড়াও অর্থনীতি পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা, আমদানি-রপ্তানি-মুদ্রা ভারসাম্য বজায় রাখা, আইনশৃঙ্খলা ও জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে রাখা।

দলের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে পর্যন্ত পুরোদমে কাজ করছে আওয়ামী লীগ। এরই মধ্যে দলের তৃণমূলকে ঢেলে সাজাতে রমজান মাসেও ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছেন দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। কেন্দ্রের নির্দেশে কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে সম্মেলনের মধ্য দিয়ে নতুন নেতৃত্ব তৈরি করছে দলটি। এতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নতুন নেতৃত্ব পুরোনো নেতৃত্বকে বাদ দিচ্ছেন। আবার বাদ পড়া নেতারা নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কথা ভেবে আলাদা বলয় তৈরি করে বিপরীতমুখী কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। ফলে তৃণমূলে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ক্রমশ বাড়ছে।

বলা যায়, আওয়ামী লীগের মূল প্রতিপক্ষ এখন আওয়ামী লীগই। এটি খুবই ভাবাচ্ছে দলের থিংকট্যাংকদের। অভিযোগ আছে, কোনো কোনো কেন্দ্রীয় নেতাও তার নিজ এলাকায় পৃথক বলয় তৈরির নেপথ্যে মূল ভূমিকায় রয়েছেন। এভাবে চলতে থাকলে আগামী সংসদ নির্বাচনকালে এটি রীতিমতো দলের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, “২০২৪ সালের শুরুতেই অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তবে দুশ্চিন্তার বিষয় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এমন একটি সময়ে অনুষ্ঠিত হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে যখন আমাদের অর্থনীতিরও একটি কঠিন দুরবস্থার ভেতর দিয়ে অতিক্রান্ত হওয়ার আশু সম্ভাবনা রয়েছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থ বছর শুরুই হয়েছে কতগুলো নেতিবাচক ও খারাপ অর্থনৈতিক সূচক নিয়ে। নেতিবাচক এই সূচকগুলো এখনো বর্তমান এবং এগুলোর ভালো অবস্থায় ফিরে আসার তেমন কোনো উজ্জ্বল সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। বরং তা আরও গভীর ও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির আস্ফালন, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ হ্রাস, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট, ইত্যাদি আরও বেড়েছে। মোটের ওপর, আমাদের অর্থনীতিতে একটি দৃশ্যমান অস্থিরতা বিদ্যমান।”

বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, “বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফের মতো আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ২০২৩ এবং তৎপরবর্তী সময়ে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে আর্থিক মন্দা ও খাদ্য সংকটের পূর্বাভাস দিয়েছে। আমাদের সরকার প্রধানও দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করে সব ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রতার ওপর জোর দিয়েছেন। এমন একটি আর্থিক অনিশ্চয়তার সময় আগামী সংসদ নির্বাচনে ভালো ফল করতে হলে আওয়ামী লীগ সমর্থিত সরকারকে অচিরেই জনমনে অর্থনৈতিক নিরাপত্তার আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, অনেক সফলতা থাকলেও ভোটাধিকার প্রয়োগের সময় বেশিরভাগ ভোটার রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় সরকারের নেতিবাচক দিকগুলোই বেশি মনে রাখে। আর তাই, আমাদের সরকারকে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেতিবাচক সূচকে ইতিবাচক করার জন্য অতিসত্বর মনোনিবেশ করতে হবে।”

রাজনীতিক সংশ্লিষ্টদের মতে, নির্বাচন ইস্যুতে বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশের চাপকে কাঁধের বোঝা বলে মনে করছে না আওয়ামী লীগ। কিন্তু উদ্বেগ রয়েছে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র নিয়ে, যা থেমে নেই। এছাড়া রয়েছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। এতো সব মোকাবিলা আওয়ামী লীগের জন্য এই মুহূর্তে বড় চ্যালেঞ্জ।

আওয়ামী লীগ নেতাদের ভাষ্য, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দল অতীতের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ থাকলে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের একজন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বলেন, “সম্প্রতি সময়ে দেখা গেছে, প্রভাবশালী দেশগুলো থেকে নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগের প্রতি যে চাপ দিচ্ছিল তা এখন অনেকটাই কম। তারা এখন আওয়ামী লীগের বিকল্প কাউকে চাচ্ছেন না কিংবা পাচ্ছেন না এই অবস্থায় আছেন। নানা সমীকরণ দেখিয়ে এসব দেশ থেকে এখন বলা হচ্ছে শেখ হাসিনা ফের ক্ষমতায় আসবেন। ফলে আওয়ামী লীগের কাছে তাদের একটিমাত্র প্রত্যাশা তা হলো-একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন।”

এদিকে, আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলছে, গত তিন মাসে সারা দেশে আওয়ামী লীগের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে ৩১ বার। এতে আহত হয়েছেন ৩৬৯ এবং নিহত হয়েছেন ৩ জন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে ১ বার। এতে আহত হয়েছেন ১১ জন। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে ১ বার। এতে ২ জন আহত হয়েছেন।

জানা গেছে, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটি ও বিভিন্ন বিভাগীয় শহরের থানা-ওয়ার্ডে কমিটি ঘোষণার পর দলের মধ্যে বড় প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এ কারণে অনেকে জেলা-উপজেলা এবং মহানগরের থানা-ওয়ার্ডের কমিটি গঠনে বিলম্ব হচ্ছে। অনেকে মনে করছেন, কমিটিতে নিজস্ব বলয় তৈরিতে সচেষ্ট থাকার অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে দলের হাইকমান্ড তাদের ওপর নাখোশ। এমতাবস্থায় কমিটি ঘোষণা হলে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে বিক্ষোভ-বিভেদ ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। রাজধানীর বাইরের অভিযুক্ত নেতাদের অনেকে শর্তসাপেক্ষে ক্ষমা পাওয়ায় আরও বেপরোয়া হয়ে এলাকায় প্রভাব বিস্তার করছেন।

এ বিষয়ে সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, “বিদ্রোহীরা ও দলের বিশৃঙ্খল নেতারা ক্ষমা পেয়ে যাওয়ায় দ্বাদশ নির্বাচনে অনেকে বিদ্রোহ করতে পারেন, বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারেন। এতে দলের চ্যালেঞ্জ আরও বাড়বে।”

একই সুরে কথা বলেছেন, চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের একজন সিনিয়র নেতা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতার বাড়ি চাঁদপুর। তারা সবাই আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশী। এতে নিজেদের বলয় তৈরির চেষ্টা অব্যাহত রাখছেন ইলিশের বাড়ি চাঁদপুরের জন্ম নেওয়া কেন্দ্রীয় এই নেতারা। এ ক্ষেত্রে দলের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থ অনেক সময় বড় হয়ে উঠছে। ফলে স্থানীয় বেশ কয়েকজন ত্যাগী নেতা রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।”

একই অবস্থা ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত আরেক জেলা মাদারীপুরেও। দলের কেন্দ্রীয় সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, যুগ্ম সম্পাদক, সম্পাদক ও সদস্য পদের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার বাড়ি মাদারীপুরে। এই নেতৃবৃন্দ দুই ভাগে ভাগ হয়ে আছেন খোদ দলের রাজনীতিতেই। এতে সেখানকার রাজনীতি অনেকটা মারমুখী হয়ে উঠেছে।

শরীয়তপুরেও একই অবস্থা। গত ৩ অক্টোবর দলের তৎকালীন সদস্য বর্তমান উপপ্রচার সম্পাদক আবদুল আউয়াল শামীম হামলার শিকার হন। হামলাকারীরা একই দলের স্থানীয় নেতা।

তৃণমূলের নেতাদের মতে, আওয়ামী লীগের ঘাঁটি বলে খ্যাত শরীয়তপুর-মাদারীপুরেই শুধু নয়, দলে বিভেদের এই চিত্র এখন সারা দেশে। আর এ কারণে সরকারের এতো সব উন্নয়নের সফলতা ম্লান হয়ে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কামরুল ইসলাম বলেন, “যেকোনো মূল্যে জনগণের আস্থা অর্জন করতে মাঠে রয়েছি। আমরা সে লক্ষ্যেই কাজ করছি। তবে আগামী নির্বাচনকে কোনোভাবেই চ্যালেঞ্জ মনে করছি না।”

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, “আওয়ামী লীগ সব সময় চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করে। এ দেশে চ্যালেঞ্জের বাইরে কোনো সময় পার হয় না। বিশ্ব অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এখন দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখা, আমদানি-রপ্তানি-মুদ্রা ভারসাম্য বজায় রেখে মানুষের জীবনে স্বস্তি রক্ষা করা সবচেয়ে বড় এবং কঠিন চ্যালেঞ্জ।”

তিনি আরও বলেন, “১৪ বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন করেছেন, স্বস্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন। করোনা, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, অবরোধ, তেল উৎপাদনকারীদের অমানবিক মুনাফার লোভের কারণে দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে করে জনজীবনে স্বস্তি কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। আগামী নির্বাচনে দেশের মানুষ নিঃসন্দেহে আবারও আওয়ামী লীগের পক্ষে থাকবে।”

Link copied!