রাজধানী ঢাকার গুলশান-২ এর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন জুবায়ের ইসলাম। তিনি পরিবারের পাঁচ সদস্য নিয়ে থাকেন শাহজাদপুরের একটি ভাড়া বাসায়। তিন কক্ষের এই বাসার ভাড়া মাসে ২০ হাজার টাকা। অথচ তিনি মাসে বেতন পান ৩৮ হাজার টাকা। জুবায়েরের আয়ের অর্ধেকের বেশি চলে যায় বাসা ভাড়ায়।
এর মধ্যে প্রতি বছর জানুয়ারিতে বাসা ভাড়া বাড়ানোকে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে জুবায়ের বলেন, বাড়ি ভাড়া দিয়ে সংসারের খরচ চালাতে প্রতি মাসেই হিমশিম খেতে হয়। এমন অবস্থায় প্রতি বছরই জানুয়ারি মাসে বাসা ভাড়া বাড়ান মালিক। কীসের ভিত্তিতে তিনি বাসা ভাড়া বাড়ান, তা কেউ প্রশ্নও করতে পারেন না। প্রতিবাদ করলে উল্টো বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেন। একটি দেশের রাজধানী শহরে এমন অব্যবস্থাপনা চলতে পারে না। দ্রুত বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রয়োগ প্রয়োজন।
মতিঝিলের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন আবুল খায়ের। তিনি থাকেন পুরান ঢাকার ওয়ারীতে। যে বাসায় তিনি থাকেন, প্রতি বছরই গড়ে ৫শ টাকা করে ভাড়া বাড়ান বাড়ির মালিক। এ নিয়ে তিনিও বাড়ি মালিকদের ওপর চরম বিরক্ত।
ক্ষোভ প্রকাশ করেন আবুল খায়ের বলেন, ‘ঢাকা শহর মধ্যবিত্তের জন্য নয়। এখানে ৪০-৫০ হাজার টাকা বেতনেও ঠিকমতো জীবনযাপন করা যায় না। বাসা ভাড়াই আয়ের অর্ধেকের বেশি চলে যায়। ভাড়াটিয়ারা নিরুপায় হয়ে থাকেন। তাদের সঞ্চয়ের বদলে প্রতি মাসেই ধার-দেনা করতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর বাড়িওয়ালা ৫শ টাকা করে বাসা ভাড়া বাড়ান। এ ভাড়া বাড়াতে ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে কোনো আলাপ করেন না। বাসা বদলের কষ্টের ভয়ে অনেকেই চুপচাপ মেনে নেন। এ অন্যায়ের দায় নগর কর্তৃপক্ষ কোনোক্রমেই এড়িয়ে যেতে পারে না।’
যদিও এমন দায়বদ্ধতা থেকে বাড়ির মালিকদের লাগাম টানার উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। সংস্থাটি ডিএনসিসি এলাকার ভাড়াটিয়া ও বাড়িওয়ালাদের অধিকার নিয়ে প্রথমবারের মতো গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করেছে। বৈঠকে বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়ারা অংশ নেবেন। বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) দুপুর দেড়টায় ঢাকার গুলশান-২ এর ডিএনসিসির প্রধান কার্যালয়ের নগর ভবনে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
ডিএনসিসি উদ্যোগ নিলেও বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে কোনো তৎপরতা নেই ডিএসসিসির। অথচ কর্মসংস্থানের সিংহভাগ রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত কাজের সন্ধানে রাজধানীমুখী হচ্ছেন। প্রতিদিনই কর্মসংস্থান বা ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় ঢাকায় আসছে মানুষ। আর এসব মানুষের প্রায় ৮০ শতাংশই ঢাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করেন। ফলে বাসার চাহিদা থাকায় নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই বাড়িওয়ালারা তাদের মনমতো বাড়িভাড়ার বোঝা চাপিয়ে দেন ভাড়াটিয়াদের কাঁধে। কোথাও যেন জবাবদিহি নেই।
ঢাকার ভাড়াটিয়ারা প্রতি নতুন বছর বাসা ভাড়া নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েন। তাদের আয়ের সিংহভাগ বাসা ভাড়ায় চলে যায়। অযৌক্তিকভাবে কোনো অবস্থায়ই বাড়ি ভাড়া বাড়ানো যাবে না। বাড়ি ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে নির্দেশনা প্রতিপালন করতে হবে।- বাংলাদেশ মেস সংঘের মহাসচিব মো. আয়াতুল্লাহ আকতার
হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়ন করে কমিশন গঠন, সমস্ত ভাড়াটিয়া চুক্তিপত্র দেওয়া বাধ্যতামূলক করা, এলাকাভিত্তিক সরকারি নির্ধারিত বাড়ি ভাড়া আইন কার্যকর করা, বাড়ি ভাড়া টাকার রশিদ ও ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন ভাড়াটিয়া ঐক্য পরিষদসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২৫ বছরে রাজধানীতে বাসা ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪শ শতাংশ। একই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম যতটা বেড়েছে, সেই তুলনায় বাসা ভাড়া বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। সংগঠনটির অন্য এক পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকার ২৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ, ৫৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া প্রায় ৫০ শতাংশ, ১২ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ ব্যয় করেন বাসা ভাড়া পরিশোধে।
ডিএসসিসির সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০০৭ সালে অভিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন রাজধানীর ৭৭৫টি এলাকায় ১০টি রাজস্ব আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প, কাঁচাবাড়ি, পাকা ঘর, সেমি পাকা, মেইন রোডের তিনশ ফিট ভেতরে এবং বাইরে পাঁচ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত প্রতি স্কয়ার ফুট ভাড়া নির্ধারণ করা করে দেয়। কিন্তু এটির প্রয়োগ করা হয়নি।
এছাড়া বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৯১ এ রয়েছে সুনির্দিষ্ট বিধান। আইনের ১৬ ধারায় বলা হয়েছে, বড় কোনো ধরনের নির্মাণকাজ বা পরিবর্তন আনা ছাড়া বাসার মালিক দুই বছরের মধ্যে মূল ভাড়া বাড়াতে পারবেন না। এ আইনেরও কোনো প্রয়োগ নেই। ফলে এলাকাভেদে প্রতি বছর ৫শ থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত বাসা ভাড়া বাড়ান মালিকেরা। এর সঙ্গে প্রতি বছরই ক্রমবর্ধমান গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল তো আছেই।
এখন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় প্রায় ২০ লাখ আবাসিক ভবন রয়েছে। এসব ভবনে প্রায় দুই কোটি মানুষ বাস করেন, যাদের ৮০ শতাংশই ভাড়াটিয়া।
আগামী জানুয়ারি সামনে রেখে বাড়ি ভাড়া নিয়ে মালিক-ভাড়াটিয়ার মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। তবে কোথাও সমস্যা সমাধানের কোনো পথ দেখা যায়নি। ভাড়াটিয়াদের অভিযোগ, দিন দিন লাগামহীনভাবে বাসা ভাড়া বেড়ে যাচ্ছে রাজধানীতে। বাসা মালিকরা ইচ্ছামতো ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করছেন। অন্যদিকে বাড়ি মালিকদের অভিযোগ, ব্যয় বাড়ছে তাদের। এতে বাধ্য হচ্ছেন ভাড়া বাড়াতে।
মহাখালীর একটি বহুতল ভবনের চতুর্থ তলায় সাত বছর ধরে ভাড়া থাকেন আক্তার হোসেন। সাত বছর আগে দুই রুমের একটি বাসা (সঙ্গে ডাইনিং রুম আছে) ভাড়া নেন ১২ হাজার টাকায়। এরপর থেকে প্রতি বছর ৫শ টাকা করে ভাড়া বেড়েছে তার। এখন ওই বাসার ভাড়া ১৫ হাজার ৫শ টাকা। এর বাইরে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানিসহ সার্ভিস চার্জ আলাদা। এ খাতে আরও প্রায় চার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা খরচ হয় তার।
বাড়ি ভাড়া নিয়ে ডিএসসিসির এমন উদ্যোগ নেয়নি। তবে এ ধরনের বিষয়গুলো নিয়ে অনেক সময় বাড়ির মালিক, ভাড়াটিয়া করপোরেশনে যান। তখন তাদের সমস্যা সমাধান করে দেওয়া হয়।-ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম
আলাপকালে আক্তার হোসেন বলেন, ‘প্রতি বছর ডিসেম্বরের শুরুতে ভাড়া বাড়ানোর নোটিশ দেন বাড়ি মালিক। নোটিশে বলা থাকে, জানুয়ারি থেকে বাসা ভাড়া বাড়বে। কারও আপত্তি থাকলে বাসা ছেড়ে দিতে। কিন্তু ৫শ টাকা বাঁচাতে বাসা বদল করলে ভাড়াটিয়াদের আরও বেশি কষ্ট হয়। তাই সবাই চুপচাপ থাকে। এভাবে গত সাত বছর ধরে চলছে।’
পল্টনের একটি বাসার মালিক গোলাম কিবরিয়া। তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর একটি বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণে বেশ খরচ হয়। এজন্য ভাড়া বাড়ানো হয়। এর সঙ্গে বাসার চাহিদাও প্রচুর থাকে। তাই যার কাছে একটু বেশি ভাড়া পাই, তাকেই বাসা ভাড়া দেই। এজন্যও কখনো কাউকে কোনো জবাবদিহি করতে হয়নি।’
হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুসারে ২০২৬ সালে বাড়িভাড়া বাস্তবায়ন ও স্বাভাবিক রাখার দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ মেস সংঘের (বিএমও) মহাসচিব মো. আয়াতুল্লাহ আকতার। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঢাকার ভাড়াটিয়ারা প্রতি নতুন বছর বাসা ভাড়া নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েন। তাদের আয়ের সিংহভাগ বাসা ভাড়ায় চলে যায়। নতুন বছরে লাগামহীন বাড়ি ভাড়া বাড়ানো কারও কাম্য নয়। অযৌক্তিকভাবে কোনো অবস্থায়ই বাড়ি ভাড়া বাড়ানো যাবে না। বাড়ি ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে নির্দেশনা প্রতিপালন করতে হবে।’
বাসা ভাড়া নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসির উদ্যোগ
আগামী ২৭ নভেম্বর বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে বাড়ি মালিক ও ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেছে ডিএনসিসি। এ বৈঠকে বাড়ি মালিক ও ভাড়াটিয়ারা অংশ নেবে। তারা বৈঠকে বাড়ি ভাড়া নির্ধারণের হার, বছরে বৃদ্ধির হার নিয়ে আলোচনা করবেন। বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএনসিসির এক কর্মকর্তা বলেন, দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবেই ওই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেছে ডিএনসসিসি। বৈঠকে সংশ্লিষ্টদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আশাকরি ফলপ্রসূ আলোচনা হবে। যার মাধ্যমে নগরবাসী উপকৃত হবেন।
যদিও রোববার (২৩ নভেম্বর) ডিএনসিসির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এ বৈঠকের বিষয়টি জানিয়ে একটি ফটোকার্ড আপলোড দেওয়া হয়। এই পোস্টের কমেন্টে রাজিব চৌধুরি নামে একজন লেখেন, ‘বাসাভাড়া নিতিমালা যদি থাকে বাস্তবায়ন করুন। ভাড়াটিয়াদের বাঁচান। লাগামহীন বাসাভাড়া নগরবাসীর জন্য চাপা কষ্টে চেয়েও ভয়ংকর।’
এমএস রাতুল নামে আরেকজন লেখেন, ‘এলাকাভিত্তিক স্কয়ার ফিট হিসেবে সরকারিভাবে ভাড়া নির্ধারণ করে দেওয়ার জন্য জোরালো ভাবে অনুরোধ করছি।’
এ বিষয়ে ডিএনসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. জোবায়ের হোসেন বলেন, ‘ওই গোলটেবিল বৈঠকে আমরা ডিএনসিসি এলাকার বিভিন্ন হাউজিং প্রতিষ্ঠান, কল্যাণ সমিতির নেতা, ভাড়াটিয়াদের আমন্ত্রণ জানিয়েছি। বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ নিয়ে তারা নিজ নিজ মতামত দেবেন। তার ভিত্তিতে ভবিষ্যতে তা কীভাবে কার্যকর করা যায়, তা নির্ধারণ করা হবে। এতে বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়া উভয়েই যাতে উপকৃত হবেন।’































