• ঢাকা
  • সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫

বছরজুড়ে ছিল ডেঙ্গুর আগ্রাসন


বিজন কুমার
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩১, ২০২৩, ০৬:৪৬ পিএম
বছরজুড়ে ছিল ডেঙ্গুর আগ্রাসন
শুধু আক্রান্তই নয়, মৃত্যু হারেও এগিয়ে রয়েছে চলতি বছরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি

নানা প্রতিকূল পরিবেশে কেটে গেল ২০২৩ সাল। কালের সাক্ষী হয়ে ২০২০ সালের মতোই সবার মনে দাগ থেকে যাবে ২০২৩ সাল।  কারণ, ২০২০ সালের করোনার দাপটের মতোই ২০২৩-এর পুরোটা জুড়ে ছিল ডেঙ্গুর আগ্রাসন।  

৩০ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৫ বছরের আক্রান্তের রেকর্ড ছাড়িয়েছে চলতি বছরের ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। হিসাব বলছে, ২০২৩ সালে গড়ে প্রতিদিন শতাধিক রোগী আক্রান্ত হয়েছে মশাবাহিত এই রোগে। শুধু আক্রান্তই নয়, মৃত্যু হারেও এগিয়ে রয়েছে চলতি বছরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি।

কেমন ছিল হাসপাতালগুলোর পরিস্থিতি

চলতি বছর মশার কাছে হার মেনেছে দেশের মানুষ। দিনেও কয়েল ও মশারি টাঙিয়ে থাকতে হয়েছে অনেককেই। রাজধানীর বেশ কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, শয্যা সংখ্যা অপ্রতুল থাকার কারণে অনেক রোগী মেঝেতে শয্যা পেতে চিকিৎসা নিয়েছেন। চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে একপ্রকার দুশ্চিন্তায় কাটাতে হয়েছে রোগীর স্বজনদের। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের উদ্যোগগুলোও কাজে আসেনি এ বছরের ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে।

যে মাসে আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি

২০২৩ সালের শুরু থেকে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫ শতাধিক। এরপর ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিলে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দুই শর নিচে নেমে এলেও মে মাস থেকে আবার বাড়তে শুরু করে আক্রান্তের হার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সব থেকে বেশি ছিল।

দপ্তরটির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জানুয়ারি মাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৫৬৬ জন। এরপর ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিল মাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৬৬, ১১১ ও ১৪৩। এরপরের মাস থেকে ডেঙ্গু দেশের মানুষের কাছে এক আতঙ্কের রোগে পরিণত হয়। বাড়তে থাকে আক্রান্তের সংখ্যা।

দপ্তরটির হিসাব অনুযায়ী, মে মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ১ হাজার ৩৬ জন। এ ছাড়াও জুনে ৫ হাজার ৯৫৬ জন, জুলাইয়ে ৪৩ হাজার ৮৫৪ জন, আগস্টে  ৭১ হাজার ৯৭৬ জন, সেপ্টেম্বরে ৭৯ হাজার ৫৯৮ জন, অক্টোবরে ৬৭ হাজার ৭৬৯ জন, নভেম্বরে ৪০ হাজার ৭১৬ জন এবং ডিসেম্বরে আক্রান্ত হয়েছে ৯ হাজার ১৮২ জন।

২০২৩ ও গত ৫ বছরের পরিসংখ্যান 
গত ৫ বছরের ডেঙ্গু আক্রান্ত হারের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে চলতি বছরের হিসাব।  স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ১০ হাজার ১৪৮ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। অন্যদিকে ২০২৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ৩ লাখ ২১ হাজার ৭৩ জন।  

এদিকে দপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ সালে আক্রান্ত হয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন। এ ছাড়াও ২০২০ সালে ১ হাজার ৪০৫ জন, ২০২১ সালে ২৮ হাজার ৪২৯ জন এবং ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৬২ হাজার ৩৮২ জন।

চলতি বছর ও গত ৫ বছরের মৃত্যু পরিমাণ

২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল। এ কয়েক বছরে দেশের মানুষ ডেঙ্গুতে সব থেকে বেশি মৃত্যু দেখেছে ২০২৩ সালে। তবে এর আগে ২০১৯ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পেলেও, এ রোগে মৃত্যুর মিছিল কখনোই ২০২৩ সালকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি।  

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের মৃত্যুর পরিমাণের ২ শতাংশ মৃত্যুও  হয়নি ২০১৮ সালে। দপ্তরটির হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছিল ২৬ জনের। আর ২০২৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ১ হাজার ৭০৩ জনের। অন্যদিকে, ২০১৯ সালে ১৬৪ জন, ২০২০ সালে ০ (শূন্য) জন, ২০২১ সালে ১০৫ জন ও ২০২২ সালে মৃত্যু হয়েছিল ২৮১ জনের।

বয়স ও লিঙ্গ অনুপাতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর তুলনামূলক চিত্র

চলতি বছরের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ৩ লাখ ২১ হাজার ৭৩ জন ব্যক্তি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে এবং মৃত্যু হয়েছে ১ হাজার ৭০৩ জনের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর আক্রান্তের সংখ্যায় সব থেকে বেশি আক্রান্ত হয়েছে পুরুষ। আর মৃত্যু বেশি হয়েছে নারীর। ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট আক্রান্তের মধ্যে পুরুষের পরিমাণ ১ লাখ ৯২ হাজার ৫৪২ জন এবং নারী আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ২৮ হাজার ৫৩১ জন। আর মোট মৃত্যুর মধ্যে ৭৩৩ জন পুরুষ ও ৯৭০ জন নারী রয়েছে।

এদিকে, আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ১৪ শতাংশ রোগীর বয়স ২১ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। যা সব বয়সের রোগীর তুলনায় বেশি। আর সব থেকে কম অর্থাৎ ০ দশমিক ৩ শতাংশ আক্রান্ত রোগীর বয়স ৮০ বছর বয়সী ব্যক্তি।

অপরদিকে, মোট মৃত্যুর মধ্যে ৩৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী ব্যক্তিরাই বেশি। যা অন্যান্য বয়সের রোগীর চেয়ে বেশি। আর সব থেকে কম মৃত্যু অর্থাৎ ২ শতাংশ মৃত্যু হয়েছে ৭৬ থেকে ৮০ বছর বয়সী ব্যক্তির।

ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে দুই সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম
চলতি বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে রাজধানীতে আতঙ্কের অপর নাম হয়ে ওঠে ডেঙ্গু। রাতের পাশাপাশি দিনেও কয়েল ও মশারি টাঙিয়ে থাকতে হয়েছে অনেকেই। এর ধারাবাহিকতায় নগরীর দুই সিটি করপোরেশন অনেকগুলো উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। যদিও এসব উদ্যোগ কোনো কাজে আসেনি নগরবাসীর।

দুই সিটি করপোরেশন ডেঙ্গু পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রতিদিনই প্রায় অভিযান পরিচালনা করেছে।এসব অভিযানে মশক নিধন স্প্রে, মশার প্রজনন স্থল ধ্বংস, সচেতনতামূলক প্রচারও দেখা গেছে।

বিশেষজ্ঞরা যা বলেছেন
ডেঙ্গু পরিস্থিতির সামাল দিতে রোগীর স্বজনকে এ বছর বেগ পেতে হয়েছে। চিকিৎসা ব্যয়সহ রোগীকে কর্মঠ করতে গিয়ে খরচের অঙ্গও বেশ বড় হয়েছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, দায়িত্বে অবহেলার কারণে এ বছর নাজুক হয়েছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেছিলেন, “২০১৯ সালের গবেষণায় সরকারি হাসপাতালের খরচ ছিল প্রায় ১০ হাজার টাকা। কিন্তু এ বছর খরচের পরিমাণ প্রায় ৩০ হাজার টাকার মতো। দায়িত্বশীল যারা রয়েছেন তাদের কিছুটা অবহেলা রয়েছে।  এই পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে সঠিক কারণ খুঁজে বের করে তার উপর পরিকল্পনা করতে হবে।”
 

Link copied!