দেশের একজন মার্জিত ও রুচিশীল ব্যক্তিকে ‘রাষ্ট্রপতি’ খুঁজছে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা দল আওয়ামী লীগ। আগামী ২৩ এপ্রিল (রোববার) বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। তিনি টানা দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করছেন। সংবিধান অনুযায়ী একজন রাষ্ট্রপতি দুই বারের বেশি ওই পদে থাকতে পারেন না। তবে অনেকেই বলছেন, রাষ্ট্রপতির দৌড়ে এগিয়ে ড. মশিউর রহমান।
বুধবার (৪ জানুয়ারি) আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন, “রাষ্ট্রপতির জন্য সংবিধান পরিবর্তন হবে না। সংবিধান সম্মতভাবেই এবং সংবিধানে বেঁধে দেওয়া সময় সীমার মধ্যে নতুন রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করবে সরকার। তবে পরপর দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আবদুল হামিদ। সেই হিসেবে তিনি আর রাষ্ট্রপতি হবার জন্য যোগ্য বিবেচিত হবেন না। এই জন্য সংসদকে আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে একজন নতুন রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করতে হবে। নতুন রাষ্ট্রপতি কে হচ্ছেন? এ নিয়ে নানারকম আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের একাধিক দায়িত্বশীল নিশ্চিত করেছে নাটকীয় কোনো পরিবর্তন না হলে পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হতে পারেন ড. মশিউর রহমান।
আজ জাতীয় সংসদ অধিবেশনে শেষ ভাষন রাষ্ট্রপতির
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ জাতীয় সংসদ অধিবেশনে বৃহস্পতিবার (৫জানুয়ারি) শেষবারের মতো ভাষণ দেন। এই ভাষণের মধ্যদিয়ে আজ জাতীয় সংসদের অধিবেশন শুরু হয়েছে। সংসদের রীতি অনুযায়ী নতুন বছরের শুরুতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ভাষণ দেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে এটাই আবদুল হামিদের শেষ ভাষণ। নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগের প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ শুরু করেছে।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে কাকে বেছে নেবে আওয়ামী লীগ
কে হচ্ছেন দেশের আগামী রাষ্ট্রপতি এ নিয়ে রাজনীতিক পাড়ার পাশাপাশি সর্বত্র নানা গুঞ্জন শুরু হয়েছে। তবে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমীন চৌধুরীসহ প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা, মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য, সাবেক একজন প্রধান বিচারপতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক একাধিক উপাচার্যের নাম রাষ্ট্রপতি হিসেবে ব্যাপক আলোচনায় রয়েছে। রাষ্ট্রপতির চলতি মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার বিধান আছে সংবিধানে। সে অনুযায়ী দেশের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে ২৪ জানুয়ারি থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে। সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি পদের মেয়াদ অবসানের কারণে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে হবে। সে অনুযায়ী আগামী ফেব্রুয়ারিতেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু ও শেষ করতে হবে।
যেভাবে নির্বাচিত হন রাষ্ট্রপতি
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি সরাসরি ভোটে নয়, সংসদ সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হন। তফসিল ঘোষণাসহ এ নির্বাচন পরিচালনা করে নির্বাচন কমিশন। প্রথমত, রাষ্ট্রপতি বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী এবং সরকার একজন আস্থাজানক ব্যক্তিকে সবার আগে বিবেচনা করবে। বিশেষ করে ১৯৯৬ সালে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদকে রাষ্ট্রপতি করার পর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা আওয়ামী লীগের হয়েছে সেখান থেকে আস্থা এবং বিশ্বাসের বিষয়টি সবার সামনে চলে এসেছে। সে বিবেচনা থেকে ড. মশিউর রহমান সন্দেহাতীতভাবেই আস্থাশীল এবং বিশ্বস্ত। এবারে যিনি রাষ্ট্রপতি হবেন তার নেতৃত্বে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবার অনেক জটিল সমীকরণের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে এবং সেখানে বিরোধী দল এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একটি বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করবে। সেই বিবেচনায় ড. মশিউর রহমান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে গ্রহণযোগ্য হবে। তিনি একজন গ্রহণযোগ্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে সুশীল সমাজ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়সহ বিভিন্ন মহলের আস্থাভাজন হতে পারে এমন বিবেচনা করছে আওয়ামী লীগ।
দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রপতি হিসেবে একজন মার্জিত রুচিশীল ব্যক্তিকে খুঁজছে আওয়ামী লীগ এবং সে বিবেচনা থেকে ড. মশিউর রহমান উচ্চ শিক্ষিত এবং যথেষ্টভাবে দলের বাইরে গ্রহণযোগ্য। এসমস্ত বিবেচনা থেকেই ড. মশিউর রহমান আগামী রাষ্ট্রপতি হতে পারেন এমন গুঞ্জন আওয়ামী লীগের শোনা যাচ্ছে।
তবে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, পরবর্তী রাষ্ট্রপতি কে হবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কাজেই তিনি যাকে বিবেচনা করবেন তিনিই হয়তো আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাবেন। সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় সংসদ সদস্যদের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবার কথা। কাজেই আওয়ামী লীগ যাকে মনোনীত করবে তিনি হবেন পরবর্তী রাষ্ট্রপতি।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের মেয়াদকাল
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল আবদুল হামিদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রথম দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। আবদুল হামিদ রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে সাতবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং স্পিকার হিসেবে দুবার দায়িত্ব পালন করেন। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি টানা দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ দায়িত্ব পালনকালে তিনি দলমত ঊর্ধ্বে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। এ ছাড়া তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহভাজন ছিলেন। আওয়ামী লীগের সর্বমহলে তিনি জনপ্রিয়। সুনাম ও সাফল্যের সঙ্গে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন বিরোধীদলীয় উপনেতা, ডেপুটি স্পিকার ও দুবার স্পিকার হিসেবে। দীর্ঘ ৪২ বছরের অন্যতম প্রধান কর্মস্থল সংসদ থেকে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন দেশের ২১তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে। রাষ্ট্রের গুরুদায়িত্ব পালনকালেও জনবিচ্ছিন্ন নন আবদুল হামিদ। তার নিজের এলাকা কিশোরগঞ্জের মানুষ শত নিরাপত্তার মধ্যেও বঙ্গভবনে এসে ভিড় করেন। তার সঙ্গে দেখা করার জন্য, কথা বলার জন্য বসে থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সময় পেলেই ছুটে যান নিজ এলাকা মিঠামইনে।
যা বলছে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কাকে দলের প্রার্থী করা হবে এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামে আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা হয়নি। তবে ইতোমধ্যে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম আলোচিত হচ্ছে। যার নাম সর্বোচ্চ আলোচনায় আছে তিনি হলেন, জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। দেশের জাতীয় সংসদের প্রথম নারী স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। স্পিকার হিসেবে তিনি ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক পরিসরেও সুনাম অর্জন করেছেন। তিনি কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। তাকেও রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করা হতে পারে। অনেকেই মনে করছেন, শিরীন শারমিন চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর অত্যন্ত বিশ্বস্ত এবং আস্থাভাজন। নির্বাচনকালীন সময়ে যেহেতু রাষ্ট্রপতি পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সে কারণে হয়তো তাকে রাষ্ট্রপতি পদে ভাবা হতে পারে। এ ছাড়াও সাবেক প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক একাধিক ভিসির নামও আলোচনায় রয়েছে। এ ছাড়া সাবেক দুজন মন্ত্রীর নামও বলছেন কেউ কেউ। পরীক্ষিত ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকেই দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করা হচ্ছে এমনটা আলোচনা আছে দলের ভিতরে-বাইরে। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকেই বঙ্গভবনে বসানো হচ্ছে। সার্বিক বিবেচনায় রেখেই সিদ্ধান্ত নেবে সরকারি দল।
আলোচনায় মশিউর রহমান
দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান। তিনি বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
২০০৯ সাল থেকে এই দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে ছিলেন ড. মশিউর রহমান। পচাঁত্তরের পরবর্তী সময়ে সরকারি চাকরিতে থাকলেও নানা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে তাকে সময় অতিবাহিত করতে হয়েছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে তিনি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং শেষ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে অবসরে যান।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার সরকার গঠন করলে ড. মশিউর রহমান প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা শুরু করেন এবং সেই দায়িত্ব তিনি এখন পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং আস্থাভাজন হিসেবে বিবেচিত ড. মশিউর রহমান। নানা কারণে ড. মশিউর রহমান রাষ্ট্রপতি হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন বলে একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে।