• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৮ জুলাই, ২০২৫, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৩ মুহররম ১৪৪৬

সফলতা-ব্যর্থতার হিসাব কষছে আওয়ামী লীগ


সফিকুল ইসলাম
প্রকাশিত: জানুয়ারি ৭, ২০২৩, ০৯:৫২ পিএম
সফলতা-ব্যর্থতার হিসাব কষছে আওয়ামী লীগ

হ্যাটট্রিক জয়ী আওয়ামী লীগ সরকারের চতুর্থ বর্ষপূর্তি ৭ জানুয়ারি (শনিবার), ১৫ বছরে পা রেখেছে। গত চার বছর বর্তমান সরকারের চলার পথ নিষ্কণ্টক ছিল না। সরকারের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, সব বাধা পেরিয়ে সরকার যতটা অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং জীবনমানের পরিবর্তন করেছে তা অতীতের কোনো সরকার করতে পারেনি। তবুও সরকার গঠনের টানা তৃতীয় মেয়াদের পঞ্চম বর্ষে দাঁড়িয়ে সফলতা-ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতার হিসাব নিকেশ কষছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার।

জানা গেছে, ২০১৮ সালের নির্বাচনে হ্যাটট্রিক জয় পেয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের মধ্য দিয়ে চার বছর পেরুনোর পাশাপাশি একটানা ১৪ বছর ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ সরকার, যা দেশের ইতিহাসে বিরল। সরকারের ধারাবাহিকতার কারণেই গত বছর পদ্মা সেতুর মতো সাহসী অবকাঠামো চালু করা সম্ভব হয়েছে। ঢাকার বুকে চলছে মেট্রোরেল। ওদিকে কর্ণফুলী টানেলও প্রায় প্রস্তুত। গত বছর একই দিনে উদ্বোধন করা হয় ১০০ সেতু এবং ১০০ সড়ক। চলছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কর্মযজ্ঞ।

তাই অনেকেই বলেন, ২০২২ আক্ষরিক অর্থেই ছিল, অবকাঠামো উন্নয়নের বছর। কেন্দ্র থেকে প্রান্ত সর্বত্র ডিজিটাল সেবা আজ দোরগোড়ায়। তবে গত চার বছর মসৃণ ছিল না সরকারের চলার পথ। একদিকে করোনার থাবা অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞা। যার রেশ চলছে এখনো। সেই ধকলে বেড়ে গেছে জ্বালানির দাম, বেড়েছে আমদানি ব্যয়ও। যার প্রভাব গিয়ে পড়ছে ভোক্তার পকেটে। এত কিছুর পরও স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে দেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে।

তাইতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুক্রবার (৬ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় সরকারের বর্তমান মেয়াদের চতুর্থ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, শিল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। জেন্ডার সমতা এবং নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষে। সরকার ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, সরকার সফল। যে কারণে দেশের মানুষ আবারও বেছে নেবে নৌকাকে।

এ বিষয়ে কথা বলেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকারের চার বছর পূর্তি হচ্ছে। একইসঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৪ বছর পূর্ণ হচ্ছে। গত এক বছর করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বিশ্বব্যাপী নানা সংকট ছিল। এরপরও দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি অব্যাহত রেখেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।” 

২০২০ সালে করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী যেভাবে করোনা মোকাবিলা করেছেন, বিশ্বসম্প্রদায় তার প্রশংসা করেছে জানিয়ে হাছান মাহমুদ বলেন, “নিক্কি ইনস্টিটিউট ও ব্লুমবার্গের যৌথ জরিপ বলছে, বাংলাদেশ করোনা মহামারি মোকাবিলার ক্ষেত্রে বিশ্বে পঞ্চম, দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম।” তিনি বলেন, “বিশ্বসংকট ও মূল্যস্ফীতির মধ্যেও বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক ক্ষেত্রে সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। আমাদের মূল্যস্ফীতি ইউরোপ ও অনেক উন্নত দেশের তুলনায় কম হয়েছে। ডিসেম্বর মাসে আমাদের রেকর্ড অঙ্কের রেমিট্যান্স এসেছে, রপ্তানি আয় বেড়েছে। গত কয়েক মাসেও রপ্তানি আয় বেড়েছে।”

সরকারের উন্নয়ন আর অগ্রগতিকে সাধুবাদ জানিয়েছেন রাজনীতিক বিশ্লেষকরাও। তারা বলছেন, মুদ্রার একদিকে যেমন উন্নতি আছে, তেমনি উল্টো পিঠে আছে নানা হতাশার গল্প।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেজবাহ কামালের মতে, এই সরকারের শেষ বছরে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারা। তার মতে, জনগণের মনের ভাষা বুঝেছিলেন বলেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘বাঙালিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না’। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার আগামীতেও জনগণের মনের ভাষা বুঝেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শে পরিচালিত হবে, সেটাই চায় কোটি বাঙালি।

বদলে যাওয়া বাংলাদেশের গল্প

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ক্ষমতার ১৪ বছর অতিক্রম করেছে (৭ জানুয়ারি)। টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকার বর্তমান মেয়াদে পদার্পণ করবে পঞ্চম বছরে। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা উপমহাদেশের এই প্রবীণ দলটি বদলে দিয়েছে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা। একটি উন্নয়নশীল দেশের বড় দুর্বলতাগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এ সমস্যাটি বুঝতে পেরেছিলেন এবং দূরদর্শী সিদ্ধান্ত ও একের পর এক প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের বড় বড় প্রকল্পের প্রশংসা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তিনি বলেন, “বর্তমান সরকার যেসব মেগা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে, যেমন: পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল ও রূপপুর, এগুলো সরকারের দূরদর্শী সিদ্ধান্তের ফসল। দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নকে অবহেলা করে কখনোই উন্নতির চিন্তা করা যায় না।” 

এ বিষয়ে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক রুমানা হক। তিনি বলেন, “যারা সমালোচনা করছে তারা দেখাক পদ্মা সেতু কিংবা মেট্রোরেলের কোনো বিকল্প আছে কি না। আগে খুলনা যেতে সময় লাগত ৯-১০ ঘণ্টা, এখন লাগে ৩ ঘণ্টা। আবার মেট্রোরেলে যানজট কতটা কমে আসবে তা সহজেই অনুমেয়। যেসব কাজ ভালো তা অবশ্যই প্রশংসা করতে হবে। পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।”

পদ্মা সেতু

স্বপ্নের পদ্মা সেতু বর্তমান সরকারের যোগাযোগ খাতের সবচেয়ে বড় অর্জন। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরই পদ্মা সেতু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এরপর ২০০১ সালে এই সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন তিনি। ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর পদ্মা সেতুর চূড়ান্ত নকশার অনুমোদন দেয়া হয়। ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকা ব্যয়ে তৈরি হয়েছে পদ্মা সেতু যার পুরোটাই দেশের টাকায়। পদ্মাসেতু দক্ষিণাঞ্চলের ১৯ জেলাকে ঢাকার সঙ্গে সংযুক্ত করেছে, যা দেশের অর্থনীতির মেরুদ-কে করেছে আরও মজবুত। চল্লিশ তলাসম পাইলিং ও দশ হাজার টনেরও বেশি ধারণক্ষমতার বেয়ারিংয়ের এই সেতু তাক লাগিয়ে দিয়েছে বিশ্বকে। আর সেতুর দুপাশে তৈরি হাইওয়ে বাংলাদেশের সড়ক ব্যবস্থায় এনেছে আধুনিকতার ছোঁয়া।

পদ্মা সেতু উদ্বোধন

ষড়যন্ত্র আর প্রতিবন্ধকতাকে পেরিয়ে স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে জাতি হিসেবে এক স্পর্ধা দেখিয়ে দিয়েছে বাঙালি। গত ২৫ জুন ১৮ কোটি মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রমত্তা পদ্মার বুকে নির্মিত হওয়া এ সেতু দাঁড়িয়ে আছে এ দেশের মানুষের সাহসের প্রতীক হয়ে। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল বিশ্বব্যাংক, অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছিল পদ্মা সেতু। কিন্তু থেমে থাকেনি এর কর্মযজ্ঞ। এ দেশের মানুষের শ্রমের টাকায় নির্মিত হয়েছে বহুমুখী এ সেতু, হাত পাততে হয়নি কারও কাছে। নির্মিত সেতুর প্রতিটি বালুকণায় লেগে আছে বাঙালির কষ্টার্জিত অর্থ। এ কেবল নিছক এক সেতু নয়, মাথা না নোয়াবার এক মূর্তিমান প্রতীক পদ্মা সেতু। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আমলে নির্মিত স্বপ্নের এ পদ্ম সেতুর কৃতিত্ব যুক্ত হয়েছে দলের পালকেও।

১০০ সেতু উদ্বোধন

একযোগে ১০০টি সড়ক সেতুর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ৭ নভেম্বর গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে এসব প্রকল্পের উদ্বোধন করেন তিনি। সেতুগুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে ৪৫টি, সিলেট বিভাগে ১৭, বরিশাল বিভাগে ১৪, ময়মনসিংহে ছয়, গোপালগঞ্জ, রাজশাহী ও রংপুরে পাঁচটি করে, ঢাকায় দুটি এবং কুমিল্লায় একটি রয়েছে। এসব সেতু উদ্বোধন ঘিরে সংশ্লিষ্ট জেলার মানুষের মধ্যে উৎসবের আমেজ বিরাজ করে।

মেট্রোরেল উদ্বোধন

স্বপ্নের মেট্রোরেলের যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। ২৮ ডিসেম্বর বেলা ১১টা ৫ মিনিটে ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে বহুল প্রতীক্ষিত ও দেশের প্রথম মেট্রোরেলের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা ও প্রধানমন্ত্রীর বোন শেখ রেহানা এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের উপস্থিত ছিলেন। মেট্রোরেলের মোট ব্যয় প্রায় ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। এরমধ্যে জাইকা ঋণ দিচ্ছে ১৯ হাজার ৬৭৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা। বাকি ১৩ হাজার ৭৯৬ কোটি ২৯ লাখ টাকা সরকারি তহবিল থেকে খরচ করা হবে। ঋণের গ্রেস পিরিয়ড ১০ বছর। পরিশোধ করতে হবে ৩০ বছরের মধ্যে।

স্মার্ট বাংলাদেশ

ডিজিটাল বাংলাদেশের পর এবার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দিয়েছেন শেখ হাসিনা। ১২ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু অন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস’ উদযাপন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “২০৪১ সালে বাংলাদেশ ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ হবে। ২০৪১-এর সৈনিক হিসেবে সবাই গড়ে উঠবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ করা হয়েছে বলেই করোনাকালে কোনো কাজ থেমে থাকেনি। এবার আমাদের টার্গেট আগামীর বাংলাদেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ।”

চার বছরের সফলতা

বিগত ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের তৃতীয় মেয়াদের চতুর্থ বছর পূর্ণ হয় শনিবার (৭ জানুয়ারি)। তৃতীয় বারের মতো ধারাবাহিক এ উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার পঞ্চম বছরে পা দিতে যাচ্ছে এ সরকার। এ সময়ে বিগত দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র, সংকটসহ নানান বাধা মোকাবিলা করতে হয়েছে সরকারকে। কিন্তু সফলতা এতটুকু থেমে থাকেনি; বরং দেশের অভাবনীয় উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব বৈশ্বিক প্রশংসা কুড়িয়েছে। আগের দুই মেয়াদে দেশকে স্থিতিশীল ও উন্নয়নকামী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে সরকার। তৃতীয় মেয়াদে এসে রোহিঙ্গা সংকট, করোনা মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিভিন্ন ধরনের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাপ সামলাতে হয়েছে। এসব কিছু সত্ত্বেও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ের কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, যা বাংলাদেশকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধের পর বাঙালির সবচেয়ে বড় অর্জনগুলো এসেছে সরকারের এ তৃতীয় মেয়াদেই। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পরমাণু প্রকল্পের মতো মেগা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে বিশ্বের সামনে একটি আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে অবস্থান গ্রহণের বার্তা দিয়েছে বাংলাদেশ। আগের দুই মেয়াদে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ও রফতানি আয় বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে সরকারের বর্তমান মেয়াদেও। কোভিড পরিস্থিতির সময়ও প্রবৃদ্ধি, রিজার্ভ, রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ে ইতিবাচক গতি ধরে রাখতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। অথচ একই সময়ে সংকটে হাবুডুবু খায় প্রতিবেশী দেশগুলোসহ উন্নত বিশ্ব। করোনা মহামারির মধ্যেও অর্থনীতির সব সূচকের ইতিবাচক অবস্থানই বলে দিচ্ছে সঠিক পথেই রয়েছে বাংলাদেশ। বাঙালির এমন কিছু স্বপ্ন গেলো চার বছরে পূরণ হয়েছে, যেগুলো দেখার দুঃসাহস আর কোনো সরকার দেখাতে পারেনি।

শতভাগ বিদ্যুতায়ন

২০০৯ সালে শেখ হাসিনা যখন দায়িত্ব নেন, তখন দেশের মাত্র ৪৭ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পেত। নিয়মিত লোডশেডিংয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত ছিল। বিদ্যুৎ খাতের এ করুণ অবস্থার কারণে বৃহৎ শিল্পগুলো যেমন একদিকে ধুঁকছিল, তেমনিভাবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়েও কোনো উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু মাত্র এক যুগের মধ্যে দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়ন নিশ্চিত করতে সমর্থ হয় সরকার। একই সঙ্গে দেশকে ডিজিটাইজড করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফলে শতভাগ বিদ্যুতায়নের সুবিধা কাজে লাগিয়ে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে ইন্টারনেট। এ কারণে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সৃষ্টি হয়েছে নতুন নতুন কর্মসংস্থান।

মোবাইল ব্যাংকিং

ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের সুবিধা কাজে লাগিয়ে সরকার ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা চালু করেছে। ফলে এখন দেশের ৮ কোটিরও বেশি মানুষ মোবাইলের মাধ্যমেই অর্থ লেনদেন ও ব্যবসাবাণিজ্য করতে পারছে। ডিজিটাল ডিভাইসকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করায় গণমানুষের অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা বহুগুণ বেড়েছে।

করোনা মোকাবিলা

২০২০ সালে আকস্মিকভাবে করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়লে পুরো বিশ্ব থমকে যায়। এক সময়ে বাংলাদেশেও হানা দেয় ভাইরাসটি। নতুন একটি রোগ, তখনও যার প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সাহসিকতার সঙ্গে এ মহামারি মোকাবিলা করেছে সরকার। করোনা প্রতিরোধে দক্ষিণ এশিয়ার আর কোনো দেশ বাংলাদেশের মতো সফল হয়নি। এভাবে মহামারি মোকাবিলায় সরকারের সফলতার গল্প অনুকরণীয় হিসেবে সারা বিশ্ব ছড়িয়ে পড়ে। করোনা সংকটের প্রথম থেকেই সরকার সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে। সচল রেখেছে দেশের অর্থনীতির চাকা। ব্যবসাবাণিজ্য পরিচালনার জন্য প্রণোদনার প্যাকেজও ঘোষণা করে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বাংলাদেশের সফলতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সক্ষমতা দেখিয়েছে এবং তা সত্যিই বিস্ময়কর।

গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, “করোনা প্রতিরোধে ভ্যাকসিন প্রদান কার্যক্রমে যুক্তরাষ্ট্র থেকেও বাংলাদেশ এগিয়ে আছে।”

 ২০২০ সালের ২৪ এপ্রিল এক নিবন্ধে করোনা প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় শেখ হাসিনার গৃহীত পদক্ষেপের প্রশংসা করে বিখ্যাত মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস। একই সঙ্গে প্রশংসা করা হয়েছে তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বেরও।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ১৬ কোটির বেশি মানুষের বাস। দেশটির প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষতার সঙ্গে সংকট মোকাবিলা নতুন কিছু নয়। এরই ধারাবাহিকতায় করোনা মোকাবিলায়ও তিনি নিয়েছেন দ্রুত পদক্ষেপ, যার প্রশংসা করেছে ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরামও।

করোনা পরবর্তী বাজেট

করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে বাংলাদেশের মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে আরও সক্ষম করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০২১-২০২৫ মেয়াদি অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। যা বাস্তবায়নে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৪ লাখ ৯৫ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। এই মেয়াদে ১ কোটি ১৬ লাখ ৭০ হাজার কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শেষে দারিদ্র্যের হার ১৫.৬ শতাংশে এবং চরম দারিদ্র্যের হার ৭.৪ শতাংশে নেমে আসবে। সামাজিক বৈষম্য ব্যাপকহারে হ্রাস করে দেশবাসীকে একটি মানবিক সমাজ উপহার দেওয়ার লক্ষ্য বাস্তবায়নে কাজ করে চলেছে সরকার।

ক্রীড়াঙ্গনে সফলতা

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর নারীদের খেলাধুলার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব ও পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করে। ফলে ২০১১ সালে ওডিআই স্ট্যাটাস পায় নারী ক্রিকেট দল। নিয়মিত পরিচর্যার কারণে ২০১৮ সালে এশিয়া কাপ জয় এবং ২০২১ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস অর্জন করে নারী ক্রিকেটাররা। দেশজুড়ে জেলাভিত্তিক খেলাধুলায় সরকারের বিশেষ পৃষ্ঠপোষতার কারণে নারীদের ফুটবল দলেও সাফল্য আসে। ২০২১ সালে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে অনূর্ধ্ব-১৯ নারী ফুটবল দল। ২০২২ সালেই প্রথমবারের মতো সাফ চ্যাম্পিয়ন হয় জাতীয় নারী ফুটবল দল।

রেলপথে বিপ্লব

২০০৯ থেকে ২০২১ পর্যন্ত ৪৫১ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণ এবং ১ হাজার ১৮১ কিলোমিটার রেলপথ পুনর্বাসন করা হয়। এরইমধ্যে ৪২৮টি নতুন রেলসেতু নির্মাণ করা হয়েছে। যমুনা নদীর ওপর ৪ দশমিক ৮ কিলোমটির দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতুর নির্মাণ কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।

রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র

২০২২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর খুলনার রামপালে নির্মিত সুপার ক্রিটিকাল কয়লাচালিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১টি ইউনিট উদ্বোধন করা হয়। যার বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১৩২০ মেগাওয়াট। প্রথম ইউনিট থেকে গ্রিডলাইনের মাধ্যমে ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়।

রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র

পাবনা জেলার রূপপুরে নির্মিত হচ্ছে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। যা আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম বড় একটি অর্জন। এ কেন্দ্রের দুটি ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। ২০২৩ সালের শেষ দিকে অথবা ২০২৪ সালের শুরুতে প্রথম ইউনিটটি উৎপাদনে যাবে। কেন্দ্রটি চালু হলে দেশের বিদ্যুৎ ঘাটতি ও মূল্য উভয়ই কমে যাবে। রূপপুরের সফল বাস্তবায়ন হলে আরও একাধিক পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কথা ভাবতে পারে সরকার।

কর্ণফুলী টানেল

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। কর্ণফুলী নদীর নিচে অবস্থিত নির্মাণাধীন সড়ক সুড়ঙ্গ। এই সুড়ঙ্গটি কর্ণফুলী নদীর দুই তীরের অঞ্চলকে যুক্ত করবে। এই সুড়ঙ্গ মধ্য দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক যুক্ত হবে। বঙ্গবন্ধু টানেলের দৈর্ঘ্য ৩.৪৩ কিলোমিটার। এই সুড়ঙ্গটি নির্মাণ হলে এটিই হবে বাংলাদেশের প্রথম সুড়ঙ্গ পথ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় নদী তলদেশের প্রথম ও দীর্ঘতম সড়ক সুড়ঙ্গপথ।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায়

সিত্রাংসহ নানান প্রকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করেছে সরকার অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে। উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষকে ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস ও যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষার জন্য টেকসই বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়। সমুদ্রের লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ থেকে উপকূলের মানুষের ক্ষেত-খামার রক্ষার জন্য উপকূলজুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে বেড়িবাঁধ। দেশের টেকসই অর্থনীতি ও বিকাশমান প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ এবং জলবায়ু রক্ষার জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে চলেছে আওয়ামী লীগ সরকার।
 

Link copied!