দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে শারমিন আহমদ বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে দাঁড় করানো হয়েছে একটি পিলারের (স্তম্ভ) ওপর; ‘বঙ্গবন্ধু পিলারের’ ওপর। এখানে অনেক মানুষের অবদান হারিয়ে গেছে; বিশেষ করে গ্রামবাংলার তরুণ, কিশোর, বীরাঙ্গনা—তাদের কাহিনিগুলো।”
শনিবার (৯ নভেম্বর) ‘শতাব্দীর কণ্ঠস্বর তাজউদ্দীন আহমদ, কন্যার চোখে, পুত্রের চোখে’ শীর্ষক এক আলোচনায় তিনি এসব কথা বলেন।
শারমিন আহমদ বলেন, ১ টাকার নোটে বঙ্গবন্ধুর ছবি, ৫, ১০, ২০, ৫০, ১০০ টাকার নোটেও বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুকে খাটো করা নয়, এটা হয়ে যায় এক ব্যক্তির ইতিহাস।
বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে এ আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে প্রকাশনা সংস্থা ঐতিহ্য। এতে তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে শারমিন আহমদ ও ছেলে সোহেল তাজ কথা বলেন।
‘তাজউদ্দীন আহমদ: নেতা ও পিতা’ বইয়ের লেখক শারমিন আহমদ বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে চলা মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের সময় আওয়ামী লীগের মধ্যে বঙ্গবন্ধু গোপনে একটি গ্রুপ লালন করেছেন। তারা গোপনে ভারতীয় আরএসএস ও গোয়েন্দাদের সঙ্গে কাজ করেছে। এটা মুক্তিযুদ্ধকে খুব ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর ধারাবাহিকতায় মুজিব বাহিনী গঠন করা হয়। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করে। এ ঘটনাগুলো কাউকে ছোট করার জন্য নয়। এগুলো ইতিহাসে আছে। কিন্তু এগুলো প্রকাশ হলে ভাবমূর্তিটা ওনারা (সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) যেভাবে করতে চেয়েছেন, ভয় করছেন সেটা ভেঙে যাবে।”
শারমিন আহমদ বলেন, “একটা সময় পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর একটা জায়গা আছেই, একটা ‘সিম্বল’। এই জায়গায় তিনি থাকবেন। এরপরের কর্ম–কীর্তি নিয়ে আলোচনা–সমালোচনা হবে। সে জায়গাটা খুলে দেওয়া দরকার।”
শারমিন আহমদ বলেন, “তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল সরকার গঠন করা হয়। এর আগে তেলিয়াপাড়ায় সেনা কর্মকর্তারা বৈঠক করেন। সেনা কর্মকর্তারা সরকার গঠনে সমর্থন দেন। পরে সেনা কর্মকর্তারা বলেছেন, তাজউদ্দীন আহমদের কাছ থেকেই তারা নেতৃত্ব পাবেন, একটা রাজনৈতিক নেতৃত্ব দরকার। এভাবে সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের সম্মিলনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিশাল গতি পায়। এগুলো ইতিহাসের বইয়ে নেই।”
তিনি বলেন, “এখনকার বাচ্চারা বিভ্রান্ত। তারা মনে করে এটা (মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস) শেখ পরিবারের গল্প। এটা রাসেল, জামাল, কামালের গল্প। এখানে গরিব মায়ের সন্তান, যারা সম্ভ্রম হারিয়েছেন, তাদের গল্প নেই।”
অনুষ্ঠানের সঞ্চালক কথাসাহিত্যিক আহমাদ মোস্তফা কামাল জানতে চান, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে কীভাবে মুক্তিযুদ্ধ চলেছে, তা জানতে চাননি বা কখনো মুজিবনগরে যাননি কেন? এর জবাব দিতে গিয়ে তাজউদ্দীন–কন্যা শারমিন ভারতের সাবেক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক জে এন দীক্ষিতের লেখা উদ্ধৃত করে বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে জানতে মুজিব আগ্রহী ছিলেন না।
শারমিন বলেন, তিনি মনে করেন, হয়তো বঙ্গবন্ধুর মনস্তাত্ত্বিক কোনো কারণ ছিল, তার অবর্তমানে একটি দেশ স্বাধীন হয়ে গেল, তখন তিনি নেতৃত্বে ছিলেন না। মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি ঠিক আপন ভাবতে পারেননি।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের ঘটনা তুলে ধরে সোহেল তাজ বলেন, “ওই রাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে (বঙ্গবন্ধুর বাসভবন) তাজউদ্দীন আহমদ একটি টেপরেকর্ডার নিয়ে গিয়েছিলেন। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র স্বাক্ষরের জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে শত শত বিদেশি সাংবাদিক অপেক্ষা করছিলেন। পরিকল্পনা ছিল ঘোষণাটি তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২৫ মার্চ সে ঘোষণাটা দেওয়া হয়নি। তাজউদ্দীন সেখান থেকে চলে আসেন। সে রাতে বাড়ি ফিরে তাজউদ্দীন খুব হতাশ ছিলেন। বাসায় ফিরে ফাইলপত্র ছুড়ছিলেন। বারবার বলছিলেন, ২৩ বছরের আন্দোলন বৃথা গেল।”
এসব কথা পরে নিজের মায়ের কাছ থেকে শুনেছেন বলে জানালেন সোহেল তাজ। পাকিস্তানি এক সাবেক সেনা কর্মকর্তার লেখা পাকিস্তানস ক্রাইসিস ইন লিডারশিপ বই থেকে উদ্ধৃত করে সোহেল তাজ বলেন, শেখ মুজিব (১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ) রাত দেড়টার সময় তার বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন। অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ নেতা সেখানে ছিলেন না। কেন মুজিব নিজে বাসায় রয়ে গেলেন এবং অন্যরা আন্ডারগ্রাউন্ডে (আত্মগোপনে) চলে গেলেন? এই প্রশ্নের জবাবে ওই বইয়ের লেখক বলেছেন, ঢাকা স্টেশন কমান্ডারকে মুজিব বলেছিলেন, তিনি পাকিস্তানকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন।
সোহেল তাজ বলেন, এখানে অনেকগুলো ‘অপশন’ (বিকল্প) ছিল। পাকিস্তান ফ্রেমওয়ার্কের ভেতরে থেকে স্বায়ত্তশাসন। এটা বিশ্লেষণ করা, ইতিহাসবিদদের খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
সোহেল তাজ বলেন, “৭ মার্চের ভাষণ ঐতিহাসিক ভাষণ। এতে বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলার মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন। সেখানে নানা দিকনির্দেশনা ছিল। এটা অনস্বীকার্য বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতীক। কিন্তু ছয় দফা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন সবকিছুতে অনেক নেতার অবদান ছিল। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ওই মুহূর্তে দেশ এসেছিল।”
 
                
              
 
																                   
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                    





























