Thus I entered, and thus I go!/ In triumphs, people have dropped down dead./ “Paid by the world, what dost thou owe/ “Me?”—God might question; now instead,/ ‘Tis God shall repay: I am safer so. —Robert Browning (The Patriot)
সমাজ যাকে নায়ক বানায়, মুহূর্তের ব্যবধানে তাকেই আবার খলনায়কে পরিণত করে। তবে এর মাঝে কিছু প্রশ্নবোধক চিহ্ন আঁকা হয়ে যায় সমাজ ও ব্যক্তির কপালে। কোনো কিছু যাচাই না করেই সমাজ কাউকে নায়ক বানিয়ে দিতে পারে, আবার সন্দেহের পাল্লা ভারী হতে থাকলে সেই একই ব্যক্তিকে সে বানিয়ে দিতে পারে খলনায়ক, কিন্তু সমাজ এমন করে কেন? আর ব্যক্তির নায়কোচিত কাজটিই বা কী? কী করলে তাকে নায়ক বলা যায়? দেখা যায়, ঔচিত্যবোধের জায়গা থেকে কেউ কোনো কিছু করলে সে-ই নায়ক বনে যায়, যেহেতু সমাজের অন্যরা সেই উচিত কাজটি এড়িয়ে যায়। অথচ কাজটি নৈতিক দায়িত্বের ভেতর পড়ে; তবে আলাদা করে কেন তাকে নায়কের তকমা দেওয়া? অথবা একজন ব্যক্তিকে যে সমাজ নায়ক বা খলনায়ক বানিয়ে দেয়, সেখানে ব্যক্তির কতখানি হাত থাকে?
আজগর ফরহাদির ‘আ হিরো’ (২০২১) ছবিটি দেখার পর ইংরেজ কবি রবার্ট ব্রাউনিংয়ের ‘দ্য প্যাট্রিয়ট’ কবিতাটির কথা মনে পড়ে যায়। আর মনের ভেতর জেগে ওঠে প্রশ্নগুলো। চলচ্চিত্রে দেখা যায় রহিম (আমির জাদিদি) নামের একজন দেনার দায়ে কারাগারে যায়। মাঝে দুদিনের ছুটিতে এসে সে কিছু স্বর্ণমুদ্রা পায় তার প্রেমিকার কাছ থেকে। প্রেমিকা জানায়, থলেটে সে কুড়িয়ে পেয়েছে। তারা সেটা বিক্রি করতে গিয়েও করে না, নৈতিক কারণে বিরত থাকে এবং মুদ্রার আসল মালিককে ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। দুদিনের ছুটি শেষ হয়ে গেলে রহিম জেলখানায় ফেরত যায়। এর মাঝে আসল মালিক দাবি করা এক নারী আসে এবং রহিমের বোনের বাড়ি থেকে ব্যাগটি নিয়ে উধাও হয়ে যায়। রহিমের বাক্প্রতিবন্ধী ছেলেকে যাওয়ার সময় সেই নারী আবার কিছু অর্থও দিয়ে যায়। তো হারানো মুদ্রা ফেরত দেওয়ার কাহিনিটি কারা কর্তৃপক্ষ জানতে পারলে গণমাধ্যমকে জানায় এবং একে একে পত্রিকা, টিভি সকলে রহিমকে নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে থাকে। পরিচিত মুখ হয়ে ওঠে রহিম।
একটি সমাজকল্যাণ সংস্থার পক্ষ থেকে রহিমকে সংবর্ধনাও দেওয়া হয় এবং তৎক্ষণাৎ গণঅর্থও সংগ্রহ করে দেয় তারা, যেন রহিমের দেনা কিছুটা শোধ করা যায়। শুধু তা-ই নয়, সংস্থার পক্ষ থেকে রহিমকে কাজের ব্যবস্থাও করে দেওয়া হয়, যাতে ধীরে ধীরে সে পাওনাদারের ঋণ শোধ করে দিতে পারে। তো পাওনাদার সেই অনুষ্ঠানে ছিল। ঠিক হয় চাকরি পেলে পাওনাদার মামলা উঠিয়ে নেবে। গোল বাধে যখন চাকরিদাতা সেই মুদ্রার মালিক নারীকে দেখতে চায়। সেই নারীকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। নিরুপায় রহিম নিজের প্রেমিকাকে মুদ্রার মালিক সাজিয়ে নিয়ে যায় চাকরিদাতার কাছে। তাদের সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়। তারা সমাজকল্যাণ সংস্থা, কারা কর্তৃপক্ষ সবার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। ওদিকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও রহিমকে ঘিরে শুরু হয় কানাঘুষা। অনেকেই ভাবছে, ঋণ পরিশোধ না করে সাজা মওকুফের জন্যই এসব নাটক সাজিয়েছে রহিম।
এর ভেতর ছেলেকে নিয়ে কটু কথা বলায় পাওনাদারের ওপর চড়াও হয় রহিম। সেই ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ সাইবার দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয় পাওনাদারের মেয়ে। এমন বিপর্যস্ত অবস্থার ভেতর সমাজকল্যাণ সংস্থা যে অর্থ তার জন্য তুলেছিল, সেটি সে দিয়ে দেয় অন্য আরেক পরিবারকে, তাদের আরও বড় বিপদ দেখে। এখানেও যা উচিত ও মানবিক, সেটাই করে রহিম। স্বার্থপর সে নয়। অন্যদিকে সংবাদমাধ্যমে নিজেদের মুখ রক্ষার জন্য কারা কর্তৃপক্ষ যখন রহিমের ছেলের বয়ান রেকর্ড করতে আসে, তখন ছেলেটি আসলে সেভাবে কিছুই বলতে পারে না, ভাঙা ভাঙা বাক্যে শুধু বোঝাতে পারে তার বাবা নির্দোষ। কিন্তু রহিম বেঁকে বসে। ছেলের বাক্প্রতিবন্ধকতা সে মিডিয়াতে প্রচার করতে রাজি নয়। লোকে হয়তো ভাববে নিজের সুবিধার জন্য সে ছেলেকে ব্যবহার করছে। তাই কারা কর্মকর্তাকে সে ভিডিও মুছে দিতে বলে। কর্মকর্তা সেটি মুছতে চায় না। এক কথায়, দুই কথায় কর্মকর্তার গায়ে হাত তুলে বসে রহিম। ব্যস, পুনর্বার কারাবাস আর কে ঠেকায়? এই হলো চলচ্চিত্রটির সারসংক্ষেপ।
এই চলচ্চিত্রের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আলোচনায় ছিল স্বর্ণমুদ্রাসহ একটি থলে, যার ভূমিকা সে রকম নেই, কিন্তু ওটাকে কেন্দ্র করেই গল্প গড়ায়। বলা যায়, থলেটা হলো ম্যাকগ্যাফিন। একে কেন্দ্র করেই সমাজ, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির নৈতিকতা, স্বার্থপরতা ও মানবিকতার পরীক্ষা করেছে চলচ্চিত্রটি। সাধারণ মানুষ, যাদের নিয়ে সমাজ গঠিত, তারা যখন পত্রপত্রিকার মাধ্যমে রহিমের ব্যাপারে জানতে পারে, তখন তারা একজন কয়েদি ও ঋণের দায়ে জর্জরিত মানুষের লোভ সংবরণের বিষয়টিকে অভিনন্দিত করে। প্রথমে কারা কর্তৃপক্ষ রহিমকে ব্যবহার করে নিজেদের দিকে আলো টেনে নেওয়ার চেষ্টা করে। পরে রহিমের খ্যাতির সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করার চেষ্টা করে সমাজকল্যাণ সংস্থা। তারা তাকে সংবর্ধনা, অর্থ সাহায্য ও চাকরি প্রদানের ঘোষণা দেয়। তারা সবাই সুসময়ের বন্ধু হয়ে ওঠে।
কিন্তু সমাজে সব সময়ই উল্টো চিন্তার স্রোত প্রবহমান। একদল লোক ভাবতে থাকে, মুদ্রার মালিককে তো কেউ দেখেনি, তবে কি রহিম মিথ্যা নাটক সাজাল? এই প্রশ্ন করা মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। সমাজেরও দৃষ্টিভঙ্গি হেলে যেতে থাকে রহিমের বিপরীত দিকে। আর এই হেলে পড়া দৃষ্টিভঙ্গিকে অনুসরণ করতে থাকে সমাজকল্যাণ সংস্থার মতো প্রতিষ্ঠান ও কারাগারের মতো রাষ্ট্রীয় যন্ত্র। অথচ কিছুদিন আগেই তারা রহিমের প্রশংসায় ছিল পঞ্চমুখ। তো এই দোলাচলের মাঝে সংকটে পড়ে রহিম ও তার পরিবার। রহিমের পরিবারও সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নেয়। চাকরিদাতার কাছে তারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়, প্রতারণার আশ্রয় নেয়।
রহিমও টালমাটাল অবস্থার ভেতর দিয়ে যায়। কখনো সে নীতিকে আঁকড়ে ধরে, আবার কখনো সে নীতিকে বর্জন করে। মুদ্রা বিক্রি করতে গিয়ে সে নীতিকে বর্জন করে, কিন্তু সেটি ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নীতিকে আঁকড়ে ধরে। চাকরি পেতে মরিয়া রহিম নীতি বর্জন করে নিজের পরিবারকে দিয়ে মিথ্যা বলায়, আবার চাকরির মায়া ত্যাগ করে নীতির সঙ্গে থাকার সদিচ্ছা প্রকাশ করে। বিপদগ্রস্ত নারীকে নিজের অর্থসাহায্য দিয়ে এবং শেষ পর্যন্ত কয়েদখানায় ফিরে গিয়েও সে নৈতিকতার পক্ষে অবস্থান করে। যদিও সে জানে এর জন্য তাকে বিসর্জন করতে হবে জীবনের মূল্যবান সময়। নিজের পরিবারের সঙ্গে সে সময় কাটাতে পারবে না। পুত্র কিংবা প্রেমিকা কাউকেই সে দীর্ঘ সময়ের জন্য কাছে পাবে না। তারপরও সে কারাগারকে বেছে নেয়, নৈতিক কারণে। তবে আশায় বসত পাতে রহিম।
শেষ দৃশ্যে পরিচালক ডিপ ফোকাসে আমাদের দেখান এক বয়স্ক মানুষ কারাগার থেকে বেরিয়ে এক নারীকে আলিঙ্গন করছেন, এরপর সবাইকে মিষ্টি বিতরণ করছেন, তারপর একটি বাসে করে তারা চলে যাচ্ছেন, করাগারে প্রবেশের মুখে এসব বসে বসে দেখছে রহিম। আমি মনে করি এই দৃশ্যটি দিয়ে শুধু রহিম নয়, দর্শকের মনেও আশা জাগিয়ে রাখেন পরিচালক, তিনি বলতে চান, একদিন রহিমও এভাবে পুনর্মিলিত হবে তার পরিবারের সঙ্গে।
নৈতিকতার পরীক্ষায় মানুষের দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থা দেখানোর পাশাপাশি ‘আ হিরো’ শেষ পর্যন্ত এক আশাবাদী ছবি। ‘অল উইনার্স, অল লুজার্স’ নামের একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখে বুঝলাম, ‘আ হিরো’ সত্যি ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত একটি চলচ্চিত্র। তবে আজগর ফরহাদি চলচ্চিত্রের কোথাও সেটি উল্লেখ করেননি বরং তিনি বলেছেন কাহিনিটি তার নিজের লেখা। তাই ছবির ভেতরকার নৈতিক দোলাচলের মতো স্বয়ং চলচ্চিত্র ও এর পরিচালককে নিয়েও দর্শকের মনে একই রকম অনুভূতির সৃষ্টি হয়। পরিচালক যদি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতেন, তাতেও কোনো কিছুর কম হতো না, কারণ ফরহাদি যে মাপের পরিচালক, যেভাবে তিনি চলচ্চিত্রের বয়ান হাজির করেন, সেটা একজন দক্ষ শিল্পীর পক্ষেই কেবল সম্ভব।