• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫

মেলায় ভিড় বাড়লেও বিক্রি কম


হাবীব ইমন
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২৪, ১০:২২ এএম
মেলায় ভিড় বাড়লেও বিক্রি কম

শুক্রবার ছিল ছুটির দিন। সকাল থেকেই ভিড় শুরু হয়। বিকেলে দেখা যায়, শাহবাগ মোড় থেকে টিএসসি পর্যন্ত সড়ক যানজটে স্থবির। ফুটপাতেও বইমেলামুখী মানুষের ঢল। শিশু-কিশোর, যুবা-বৃদ্ধ—সবাই সেই দলে। মেলার প্রাঙ্গণেও বইপ্রেমী ও দর্শনার্থীর ঢল।

নবম দিন পেরিয়ে গেল অমর একুশে বইমেলা। পাঠকেরাও আসছেন যথেষ্ট। মুখর হয়ে উঠেছে বইমেলা প্রাঙ্গণ। বিশেষ করে মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে বিকেলে যেন ঢল নামে।

শুক্রবার (৯ ফেব্রুয়ারি) সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় বইমেলায় দর্শক সমাগম অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি। তবে প্রকাশকরা বলছেন, দর্শকদের ভিড় থাকলেও সে অনুযায়ী বাড়েনি বইয়ের বিক্রি। সামনের দিনগুলোতে বিক্রি বাড়তে পারে বলে তারা আশাবাদী।  

সাহিত্যাদেশের প্রকাশক শফিক সাইফুল বলেন, “মেলায় যে হারে মানুষ এসেছে, সে হারে বিক্রি হয়নি। অনেকে দলবলসহ স্টলে আসেন। তাদের মধ্যে কেউ বই কেনেন, আবার কেউ কেনেন না। তাই স্টলের সামনে জটলা থাকলেও বই বিক্রি তেমন বাড়েনি।”

তবে মেলায় ভিড় বাড়াটাকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন বাউণ্ডুলের প্রকাশক অনিন্দ্য দীপ। তিনি বলেন, “মানুষ আসছে, বই কিনছে না, এটা নিয়ে অনেকের অভিযোগ আছে। আমি তেমনটা ভাবছি না। মানুষ আসছে, বই নেড়েচেড়ে দেখছে, এটা হলো আসল কথা। আজ না কিনলে কাল কিনবে। বইয়ের যে উৎসব, সেটা তো দেখা যাচ্ছে।” 

একই কথা বললেন কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক ইমন চৌধুরী। তবে তিনি আরেকটু যোগ করেন, “সবাইকে যে পাঠক হতে হবে, তা কিন্তু নয়।” তিনি বলেন, “মেলায় যে ধরনের বই আসছে, সেগুলো বেশির ভাগই অসম্পাদিত, যার ফলে গুণগত পাঠযোগ্য বইয়ের অভাব রয়েছে। এদিকটায় বাংলা একাডেমির একটা ভূমিকা থাকা উচিত বলে মনে করেন এ লেখক।

পূঁথিনিলয়ের সঙ্গে কথা হলো কার্টুনিস্ট ও লেখক কাওসার মাহমুদের সঙ্গে। প্রতিদিনই তিনি মেলায় আসেন। এবারের মেলায় তার আঁকা ও লেখা কয়েকটি বই এসেছে। তিনি  বলেন, “বইমেলা আমার বরাবরই ভালো লাগে। অনেক পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়। বই নিয়ে পাঠকদের সঙ্গে সরাসরি আলাপ-আড্ডা হয়।” কাওসার মাহমুদ মেলার স্টল সাজানো নিয়ে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, এবার মেলায় স্টলগুলো প্রায় এলোমেলো। পাঠকদের স্টল খুঁজে পেতে অনেক বেগ পেতে হচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলা একাডেমিকে যত্নশীল হওয়া উচিত ছিল।”

গতকালই মেলায় এসেছে কবি সোহেল হাসান গালিবের বই ‘আমার খুতবাগুলি’।  প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার এ বই সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমার বই আপনারা বছরব্যাপী পড়তে পারবেন। যে কোনো পৃষ্ঠা থেকে শুরু করা যাবে। তবে সবচেয়ে ভালো হবে উল্টো দিক থেকে পড়া। সহি কিতাব যেভাবে পড়তে হয় আর কি।” তিনি বলেন, “এ বইয়ের মধ্যে ভাষার রাজনীতি আছে। যেটা হয়তো পাঠক মনে উসকে দিতে পারে।”

একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মুহু আরজু বলেন, “মেলার স্পেস দেখে এবার ভালো লাগছে। কিন্তু ধুলো-ময়লা বিষয়ে আয়োজকদের একটু সতর্ক থাকা উচিত।”

সকালে ছিল শিশুপ্রহর
শুক্রবার সকালে ছিল শিশুপ্রহর। বেলা ১১টায় মেলার মূল ফটক খুলতেই শিশুচত্বরে ঝাঁপিয়ে পড়ে কচিকাঁচারা। এবারও তাদের আনন্দ দিতে উপস্থিত জনপ্রিয় কার্টুন সিরিজ সিসিমপুরের চরিত্রেরা। হালুম, টুকটুকি, শিকু, ইকরির সঙ্গে সময় কাটে ওদের। ছিল চিত্রাঙ্কন ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতা। কেউ কেউ কিনে নিয়েছে বইও। গল্প, কবিতা, ছড়া, কমিকসসহ নানা রকম বই কিনে মেলার মাঠেই পড়তে শুরু করে কেউ কেউ। অভিভাবকরাও তাদের দিয়েছেন সমান উৎসাহ। শিশুদের উচ্ছ্বসিত দেখে খুশি তারাও।

আজিমপুর থেকে আসা ছয় বছরের মিম জানায়, তার কার্টুন ভালো লাগে। তাই সে কার্টুনের বই কিনেছে। তারা বাবা রাইসুল ইসলাম বলেন, “বাচ্চাকে নিয়ে সকালে এসেছি, বিকালে ভিড় হবে তাই। ওর পছন্দের বই দেখছে, কিনছে। এর আগে সিসিমপুর দেখেছে। খুব খুশি হয়েছে।”
ময়ূরপঙ্ক্ষী স্টলে প্রকাশনাটির প্রকাশক মিথি ওসমান বলেন, “শিশু প্রহরে আজ শিশুদের উপস্থিতি খুব ভালো। সবাই বই দেখছে, কিনছে। বেশি বিক্রি হচ্ছে কার্টুনের বই।”

মেলায় নতুন বই
বাংলা একাডেমি জানিয়েছে, গতকাল নবম দিনে মেলায় ১৭০টির বেশি বই এসেছে। ৯ দিনে আসা মোট বইয়ের সংখ্যা ৬৭১। গতকাল মেলায় আসা বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত রায়হান রাইনের ‘আগুন ও ছায়া’, নয়নজুলি থেকে কবি অসীম সাহার ‘নির্বাচিত পঞ্চাশ’, অনিন্দ্য প্রকাশ থেকে সুরমা জাহিদের ‘বীরাঙ্গনাদের ভয়াবহ স্মৃতি’।

শিশুদের বই কম, বৈচিত্র্যও কম
প্রতিদিনই বইমেলায় আসছে নতুন নতুন বই। তবে সংখ্যার বিচারে শিশুতোষ বই যেমন কম, তেমনি এতে বৈচিত্র্যও সীমিত। অসংখ্য বানান ভুল, মানহীন ছড়া, নিম্নমানের অলংকরণ আর অসংলগ্ন প্রচ্ছদে ভরা অনেক বই শিশুদের উপযোগী কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অভিভাবকরা। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মেলায় আসা শিশুতোষ বইয়ের মধ্যে অধিকাংশই ভূতের ছড়া ও গল্প এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। এর বাইরে অন্য বিষয়ে বই কম। যা আছে, তাতেও নতুনত্ব এবং মৌলিকত্ব কম থাকায় হারিয়ে ফেলছে আকর্ষণ।

কয়েক বছর থেকেই শিশুদের নির্বিঘ্নে বই কেনার জন্য মেলায় আলাদা শিশু কর্নার করা হয়েছে। সেখানে বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেছে অনেক প্রকাশনী। শিশুতোষ প্রকাশনাগুলোর বাইরে মূলধারার প্রকাশনাগুলোও শিশুদের বই বাজারে এনেছে। শিশুদের বইমুখী করতে কয়েক বছর ধরে শুক্র ও শনিবার বইমেলায় আয়োজন করা হয় শিশু প্রহর। এ সময় মেলায় এসে সিসিমপুরের চরিত্র হালুম, টুকটুকি, শিখু, ইকরিদের সঙ্গে আনন্দে মাতে শিশুরা। তাদের জন্য এত আয়োজন থাকলেও শিশুদের বইয়ের মান বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নজরে পড়েনি।

মিরপুর থেকে পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া শাহ আখন্দকে নিয়ে মেলায় এসেছেন বাচিক শিল্পী রাহে মদিনা কারী। তিনি বলেন, “ছেলে একটি ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে। তার জন্য ইংরেজি ভাষায় লেখা মানসম্মত বই পেলাম না।”

শিশুতোষ বই নিয়ে কথা হয় বেশ কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে। তাদের অধিকাংশেরই অভিযোগ বইয়ের মান ও বৈচিত্র্য নিয়ে। তাদের মধ্যে একজন কর্মজীবী তানজিলা জাহান। আট বছরের তারাজকে নিয়ে মেলায় এসেছিলেন তিনি। শিশুচত্বরে কথা হলে তিনি বলেন, ৫টি স্টলের বই দেখে আমার মেয়েকে পড়তে দেওয়ার উপযোগী এমন বই পেয়েছি মাত্র ৬টি। তিনি বলেন, অধিকাংশ বইয়ের ছাপা ও লেখার মান খারাপ। ছবির সঙ্গে লেখার মিল নেই। আবার বইয়েও কোনো বৈচিত্র্য নেই। বইয়ে যদি বৈচিত্র্য না থাকে, তবে তা শিশুদের মাঝে কতটুকু সৃজনশীলতা আনতে পারবে?

প্রকাশনায় নারীরা
বইমেলায় অংশগ্রহণ করছে ৬৩৫টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে নারীরা পরিচালনা করেন, এমন প্রকাশনীর সংখ্যা হাতে গোনা যায়। মাত্র ১৫ থেকে ২০ জন প্রকাশক নারী। তারা বলছেন, নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে নারীরা প্রকাশনায় আসছেন না। যারা এসেছেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ এসেছেন উত্তরাধিকারসূত্রে, কেউ এসেছেন প্রাণের টানে। অবশ্য এমনও আছেন, যারা প্রকাশনায় যুক্ত হয়েছেন একেবারেই পেশাদারি চিন্তা থেকে।

একসময় একটি কোম্পানিতে চাকরি করতেন সুবর্ণ প্রকাশনীর প্রকাশক শাহরিন হক। কিন্তু বাবা আহমেদ মাহফুজুল হকের মৃত্যুর পর হাল ধরতে হয় তাকে। অবশ্য ছোটবেলা থেকেই প্রকাশনা-সংক্রান্ত কাজের সঙ্গে পরিচয় ছিল তার। কারণ বাসার নিচেই ছিল প্রেস ও বাইন্ডিং কারখানা। বইয়ের প্রুফও দেখতেন তিনি। শাহরিন হক বলেন, “এটা সৃজনশীল একটি পেশা। এই পেশায় প্রকাশক নারী নাকি পুরুষ-এটা খুব একটা গুরুত্ব বহন করে না। তবে এটা ঠিক যে অন্য সব পেশার মতোই এই পেশায় ‘নারী’ হিসেবে আমাদের অল্পবিস্তর প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়।”

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইউনিভার্সিটি প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স লিমিটেড (ইউপিএল), জাগৃতি, চিলড্রেন বুক কালেকশন, চয়ন প্রকাশন, ধ্রুপদী পাবলিকেশন্স, পেন্ডুলাম পাবলিশার্স, আনন্দম, চিত্রা প্রকাশনী, জলধি, প্রত্যয়, চিত্রা, আনন্দম, ঝুমঝুমি, অধ্যয়ন প্রকাশন, বলাকা প্রকাশনী, বৈভব, আনন্দম, অভ্রসহ কয়েকটি প্রকাশনার নেতৃত্ব দিচ্ছেন নারীরা।

Link copied!