সমরেশ মজুমদার প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর মতো একজন ঋদ্ধ লেখকের লৌকিক প্রয়াণের ঘটনা বাংলা সাহিত্যের নিয়মিত পাঠকের মনে দুঃখের জন্ম দেবে। কিন্তু একজন সমরেশ মজুমদার তাঁর বর্ণিল সাহিত্যিক জীবনের দ্বারা যে সমৃদ্ধ সৃষ্টি রেখে গেছেন সেই আবেদন পাঠকের মন থেকে মুছে যাওয়া অসম্ভব বলে মনে করি।
যারা নিয়মিত বর্তমান সময়ের বাংলা সাহিত্য পড়েন, গবেষণা করেন বা অন্ততপক্ষে খোঁজখবর রাখেন তাদের কাছে এ কথা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই যে, সমরেশ মজুমদার বাংলা কথাসাহিত্যের এক উজ্জ্বল প্রতীক, এক অদ্বৈত নক্ষত্র। একজন সমরেশ মজুমদার যে শুধু বাংলা সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী ছিলেন তা নয়, সাহিত্যিক জীবনের শুরু থেকেই মঞ্চ নাটক ও গ্রুপ থিয়েটারের প্রতি সমরেশ মজুমদারের ঝোঁক ছিল প্রবল। তাঁর প্রথম গল্প ‘অন্যমাত্রা’ লেখা হয়েছিল মঞ্চনাটক হিসেবে এবং এই গল্পটি ১৯৬৭ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় গল্প হিসেবে ছাপা হয় আর সেখান থেকেই শুরু হয় তাঁর লেখকজীবনের জয়যাত্রা। পাঠকের সামনে উপন্যাসিক হিসেবে এই অসামান্য প্রতিভার আবির্ভাব ১৯৭৫ সালে, সে বছরেই সমরেশ মজুমদারের প্রথম উপন্যাস ‘দৌড়’ ছাপা হয়েছিল ‘দেশ’ পত্রিকাতেই, তখন লেখকের ছদ্মনাম ছিল গৌচপ্রম।
সমরেশ মজুমদারের শৈশব কেটেছে ডুয়ার্সের গয়েরকাটা চা বাগানে, সেখানেই শিক্ষাজীবনের শুরু, এরপর কলকাতায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি টেনে সেখানেই জীবিকার তাগিদে স্থায়ী হয়েছিলেন। তাই চা বাগানের মদেসিয়া সমাজ থেকে কলকাতার নিম্নবিত্ত মানুষেরা বারবার তাঁর কলমে উঠে এসেছেন বাস্তবতার রক্তমাংস নিয়ে।
একজন প্রতিভাধর লেখক হিসেবে সমরেশ মজুমদার তাঁর লেখনি শুধুমাত্র গল্প বা উপন্যাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি; সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা যেমন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, গোয়েন্দাকাহিনি, কিশোর উপন্যাসের মতো শাখাগুলোতেও রয়েছে তাঁর উজ্জ্বল স্বাক্ষর। তাঁর প্রত্যেকটি উপন্যাসের বিষয় ভিন্ন, রচনার গতি এবং গল্প বলার ভঙ্গি ও প্রেক্ষাপটের নান্দনিকতা পাঠকদের আন্দলিত করেছে গত কয়েক যুগ ধরে। বাংলা কথাসাহিত্যের পাঠকদেরকে সমরেশ মজুমদার তাঁর লেখনির চৌম্বক শক্তি দ্বারা প্রবলভাবে টেনেছেন গর্ভধারিণী, অগ্নিরথ, সিংহবাহিনী, এত রক্ত কেন, কলিকাতায় নবকুমার, সাতকাহন, তেরো পার্বণ, স্বপ্নের বাজার, উজান, গঙ্গা, বুনোহাঁস, ভিক্টোরিয়ার বাগান, আট কুঠুরি নয় দরজা, অনুরাগসহ বাংলা সাহিত্যে তাঁর অমর ট্রিলজি ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’ ইত্যাদি সৃষ্টি সমূহের মাধ্যমে।
সমরেশ মজুমদারের লেখায় সাবলীলতা, স্পষ্ট ঘটনার বিস্তার ও নিপুণ পরিমিতিবোধ তাঁকে আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যে খ্যাতি এনে দিয়েছে। জন্মসূত্রে তিনি উত্তরবঙ্গের লোক। কিন্তু তাঁর লেখার সঙ্গে একটা আত্মীয়তা অনুভব করে পূর্ববাংলা তথা অধুনা বাংলাদেশের মানুষ। তাঁর রচিত এমন বহু সাহিত্য রয়েছে যার মাধ্যমে সরাসরি পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের প্রক্ষাপট এসেছে একান্নবর্তী পরিবারের মতো। তাই একজন সমরেশ মজুমদার পশ্চিমবঙ্গ নাকি বাংলাদেশে বেশি জনপ্রিয়? —এমন প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যে কারও পক্ষে কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়াবে। তবে জীবনের শেষ পর্বে এসে তিনি যত সৃষ্টি রচনা করেছেন তার মধ্যে কী উপন্যাস কী ছোটগল্প, তিনি ফিরে গেছেন তাঁর নিজের জন্মভূমিতে, উত্তরবঙ্গে। সমরেশ মজুমদার তাঁর জীবনের শেষ সময়ের রচনাগুলোতে উত্তরবঙ্গের প্রক্ষাপট ফুটে উঠেছে প্রাণবন্ত হয়ে।
সমরেশ মজুমদার তাঁর রচনাতে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এনেছেন বারবার। কিন্তু সেসব প্রেক্ষাপটকে তিনি সময়ের মধ্যে বস্তবতার নিরিখে যেভাবে অঙ্কন করেছেন তাতে কোনোরূপ ঝোঁক পরিলক্ষিত হয়নি। তাঁর গল্প উপন্যাসে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এসেছে সময়ের সাক্ষী দিতে। এদিক থেকে তিনি একজন নির্মোহ সাহিত্যিকের পরিচয় দিয়েছেন সব সময়ে। অবশ্য সময়ের সাক্ষী বহন করা এই রাজনৈতিক প্রেক্ষপটের জন্য সমরেশ মজুমদারকে যে সমালোচনা সহ্য করতে হয়নি, তা নয়। কিন্তু একজন নির্মোহ সাহিত্যিক এ সমালোচনায় কান দেবেন কেন? সমরেশ মজুমদার তাই নিজের পথ নিজেই হেঁটেছেন, সমালোচনায় হোঁচট খেয়েছেন। কিন্তু সে হোঁচটের প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেননি।
সাহিত্যে আলোচনা, খ্যাতি, সমালোচনা এসব থাকবেই। কিন্তু একজন দৃঢ় মনস্ক সাহিত্য হওয়ার জন্য যে স্পৃহা দরকার জীবনজুড়ে, তার পুরোটাই দেখিয়ে গেছেন সমরেশ মজুমদার। তাই তিনি একজন সমরেশ মজুমদার হয়েই বেঁচে থাকবেন পাঠকের হৃদয়ে।
                
              
																                  
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    






































