ইরানজুড়ে গুঞ্জন। দেশটির রাজধানী সর্বত্র সবার মুখে একটাই প্রশ্ন, ‘সর্বোচ্চ নেতা কোথায়?’ ১২ দিনে যুদ্ধ, হামলা, প্রতিশোধ, যুদ্ধবিরতি—সবই ঘটেছে। অথচ আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির দেখা নেই। নেই কোনো বার্তা। নেই কোনো ছবি।
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের সরাসরি সম্প্রচারে উপস্থাপক মুখোমুখি হয়েছিলেন খামেনির দপ্তরের কর্মকর্তা মেহদি ফাজায়েলির। তার কাছে উপস্থাপক সোজা প্রশ্ন করলেন, ‘মানুষ খুব উদ্বিগ্ন। সর্বোচ্চ নেতার অবস্থা কী?’ ফাজায়েলির উত্তর রহস্যে মোড়া, ‘আমার কাছেও অনেক প্রশ্ন এসেছে। আমাদের সবার দোয়া করা উচিত। যারা তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন, তারা ঠিকঠাক কাজ করছেন। ইনশা আল্লাহ, আমাদের দেশের মানুষ বিজয় উদ্যাপন করবে তাদের নেতার পাশে দাঁড়িয়ে।’
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে খামেনিই দেশের সব বড় সিদ্ধান্তের শেষ কথা বলেন। অথচ গত এক সপ্তাহে দেশের বড় বড় সংকটের মধ্যেও তিনি প্রকাশ্যে দেখা দেননি বা কোনো বক্তব্য দেননি। কয়েক দিন আগেই যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালায়। এর জবাবে ইরান কাতারে অবস্থিত একটি মার্কিন ঘাঁটিতে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। এরপর ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতির চুক্তি হয়, যা মঙ্গলবার সকালের দিকে কার্যকর হয়েছে।
এসব ঘটনার মধ্যেও খামেনি নিখোঁজ। সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, নিরাপত্তার কারণে তিনি বাংকারে অবস্থান করছেন এবং ইলেকট্রনিক যোগাযোগ এড়িয়ে চলছেন, যাতে তাঁকে টার্গেট করে হত্যা করা না যায়। কিন্তু তার এই অনুপস্থিতি সবাইকে বিস্মিত ও আতঙ্কিত করে তুলেছে।
রাজনীতি ও সামরিক অঙ্গনে চাপা গুঞ্জন—তিনি কি বেঁচে আছেন? আহত? নাকি...! ইরানের ‘খানেমান’ নামে একটি রিয়েল এস্টেটভিত্তিক দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক মোহসেন খালিফে বলেন, ‘তার কয়েক দিনের অনুপস্থিতি আমাদের মতো যারা তাকে ভালোবাসি, তাদের গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।’ তিনি বলেন, ‘যদি খামেনি মারা যান, যা দুই সপ্তাহ আগেও অকল্পনীয় ছিল—তবে তার জানাজা হবে সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ ও ঐতিহাসিক।’
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে খামেনির অনুমতি ছাড়া দেশ এমন বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে হামলা বা ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির মতো সিদ্ধান্তের পেছনে তার মতামত ছিল কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। কারণ, সেনা কর্মকর্তারা এবং সরকারের উচ্চপর্যায়ের অনেকেই নিশ্চিতভাবে বলতে পারছেন না, তারা সাম্প্রতিক সময়ে খামেনির সঙ্গে সরাসরি দেখা করেছেন কি না বা কথা বলেছেন কি না।
ইরানের প্রভাবশালী সামরিক উপদেষ্টা জেনারেল ইয়াহিয়া সাফাভির ছেলে ও সামরিক বিশ্লেষক হামজা সাফাভি বলছেন, ইসরায়েলের হাত থেকে বাঁচতে খামেনি বাংকারে। বাইরে যোগাযোগ সীমিত। কিন্তু কেউ নিশ্চিত নয়—তিনি আদৌ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন কি না।
সাফাভি আরও বলেন, দেশের সংকট মোকাবিলায় এখন ‘বাস্তববাদী’ চিন্তাভাবনা গুরুত্ব পাচ্ছে। যার অর্থ, প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানসহ অন্য নেতাদের ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। তারপরও অনেক খামেনি-সমর্থক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিচ্ছেন, একে-অপরকে বার্তা পাঠাচ্ছেন। বলছেন, খামেনিকে না দেখে বা না শুনে তারা মনে করতে পারছেন না যে, ইরান ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ জয় করেছে।
সরকারের অভ্যন্তরীণ নীতিনির্ধারণী আলোচনায় যুক্ত চার শীর্ষ ইরানি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, খামেনির অনুপস্থিতিতে রাজনীতিবিদ ও সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়েছে। বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে—কেউ কেউ পারমাণবিক কর্মসূচি আরও এগিয়ে নিতে চায়, কেউ আবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বসার পক্ষপাতী।
এই মুহূর্তে যে পক্ষ কিছুটা এগিয়ে আছে, তারা কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার ও মধ্যপন্থার পক্ষে। এর নেতৃত্বে আছেন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান, যিনি স্পষ্টভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আবার আলোচনায় ফিরতে রাজি হয়েছেন, এমনকি ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালানোর পরও। এই শিবিরে আছেন বিচার বিভাগের প্রধান গোলাম-হোসেইন মোহসেনি-ইজেই এবং সশস্ত্র বাহিনীর নতুন প্রধান মেজর জেনারেল আবদোররহিম মুসাভি।
ব্রিটিশ থিংক ট্যাংক চ্যাথাম হাউসের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা বিভাগের পরিচালক সানাম ভাকিল বলেন, খামেনির অনুপস্থিতি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং এটা বোঝায় যে, ইরানের নেতারা এখন খুবই সতর্ক অবস্থানে আছেন। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যদি আশুরার আগে খামেনিকে দেখতে বা শুনতে না পাই, তাহলে সেটা খুব খারাপ সংকেত হবে। তাকে অবশ্যই জনসমক্ষে আসতে হবে।’
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে অতি গোপনীয় নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ। সেখানে তাকে শীর্ষ একটি ইউনিট সুরক্ষা দিচ্ছে। গোপন রাখা হয়েছে তাদের পরিচয়। এমনকি ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারাও জানেন না ওই শীর্ষ ইউনিটে কারা রয়েছেন।
ইসরায়েলি গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা দেশটির বিভিন্ন স্থানে অনুপ্রবেশ করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ কারণেই এই বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করছেন দেশটির শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা। এক ইরানি কর্মকর্তা বলেন, ‘খামেনি বাংকারে নেই। তবে তার জীবন বিপদের মধ্যে রয়েছে। বিশেষ একটি ইউনিট তার সুরক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে। তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে কেউ অবগত নন। এটি করা হয়েছে অনুপ্রবেশ ঠেকানোর স্বার্থে।’
খামেনি বহু আগে থেকেই বলে আসছেন, ইসরায়েল তার প্রাণ হরণের চেষ্টা করতে পারে। সম্প্রতি ইসরায়েল হামলা চালিয়ে অন্তত ১১ জন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এবং ১৪ জন পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যা করায় খামেনির প্রাণনাশের ঝুঁকি অন্য সময়ের তুলনায় বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
আর তাই, সবার নজর এখন আশুরার দিকে। সময় যত গড়াচ্ছে, রহস্য ততই ঘনীভূত হচ্ছে। খামেনি কি আশুরার আগেই সামনে আসবেন? নাকি ইরানের ভবিষ্যৎ নিয়েই শুরু হবে এক নতুন অধ্যায়?