• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৫, ৪ পৌষ ১৪৩২, ২৭ জমাদিউস সানি ১৪৪৭

ভিসা দেওয়ার আগে সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট পরীক্ষা করবে ভারত


সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৯, ২০২৫, ১১:০৭ এএম
ভিসা দেওয়ার আগে সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট পরীক্ষা করবে ভারত

কুষ্ঠিয়ার মেয়ে আফসারা আনিকা মিম ২০১৮ সালে ভারতের শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগের ছাত্রী হিসেবে ভর্তি হয়েছিলেন। পরের বছর যখন ভারত জুড়ে নাগরিকত্ব আইনের (সিএএ) বিরুদ্ধে তীব্র বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ শুরু হলো, তার কিছুদিন পরই তিনি নিজের ফেসবুকে সহপাঠীদের আন্দোলনের কিছু ছবি শেয়ার করেন।

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওই ছাত্রীর কাছে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিদেশি নাগরিক নথিভুক্তিকরণ বিভাগের (এফআরআরও) চিঠি আসে, সোশ্যাল মিডিয়াতে ‘ভারত-বিরোধী পোস্ট’ করার জন্য তার ভিসা বাতিল করা হচ্ছে— তাকে অবিলম্বে ভারত ছাড়তে হবে। আনিকার মাথায় কার্যত আকাশ ভেঙে পড়ে, নিজে কোনও বিক্ষোভে অংশ না নেওয়া সত্ত্বেও তাকে যে ভারত ছাড়ার হুকুম দেওয়া হবে তা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি।  

ওই একই নাগাদ কলকাতার ধর্মতলায় বাংলাদেশি একজন পর্যটক সিএএ-বিরোধী বিক্ষোভ হচ্ছে দেখে দাঁড়িয়ে পড়েন এবং বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে মিলে স্লোগানও দেন। সেই ছবি সোৎসাহে নিজের ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট করার পর দিনই তা ভারতীয় গোয়েন্দাদের চোখে পড়ে এবং পরদিনই তাকে পত্রপাঠ বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে দেশে ফেরত পাঠানো হয়।

গত বছরের (২০২৪) আগস্টে আসামের শিলচরে এনআইটি-তে (ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) ইলেকট্রনিক ও কমিউনিকেশন্স বিভাগের চতুর্থ বর্ষের বাংলাদেশি ছাত্রী মাইশা মাহজাবিনকেও প্রায় রাতারাতি করিমগঞ্জের সুতারকান্দি সীমান্ত দিয়ে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মাইশার অপরাধ ছিল, তিনি কোনও এক বন্ধুর ভারত-বিরোধী পোস্টে ‘হার্ট’ সাইনের ইমোজি দিয়ে সংহতি প্রকাশ করেছিলেন।

আবার একই বছরের সেপ্টেম্বরে চ্যাংড়াবান্ধা সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন বাংলাদেশি পর্যটক মোহাম্মদ আলমগীর। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, ভারতে ঢোকার পর থেকেই তিনি নিয়মিত ফেসবুকে ভারতের বিরুদ্ধে লেখালেখি করে চলেছেন। সেই বিষয়টিতে কেউ বা কারা ভারতের এফআরআরও-র দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তাকেও বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয় ওই চ্যাংড়াবান্ধা দিয়েই।  

ওপরে উল্লিখিত ঘটনাগুলো নেহাত কয়েকটি দৃষ্টান্ত মাত্র। কিন্তু এই ধরনের বেশ কয়েকটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই ভারত সরকার এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে যারা ভারতীয় ভিসার আবেদন করবেন তাদের গত বেশ কয়েক বছরের সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট যাচাই-বাছাই করেই ভিসা দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ভারত সরকারের একাধিক শীর্ষস্থানীয় সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।  

তারা জানাচ্ছেন, আগে যেটা মাত্র কয়েকটি ‘হাতেগোনা বা বিচ্ছিন্ন কেস’ হিসেবে করা হতো, এখন থেকে সেটাই চালু হবে ‘নিয়ম’ হিসেবে।

এখানে বলা যেতে পারে, মার্কিন ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে ওয়াশিংটন যেমন গত বেশ কিছুকাল ধরে আবেদনকারীর অন্তত বিগত পাঁচ বছরের সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইল পরীক্ষা করার নীতি নিয়েছে, ভারতও বাংলাদেশি নাগরিকদের ভিসা মঞ্জুর করার ক্ষেত্রে অবিকল সেই একই মডেল অনুসরণ করতে চাইছে।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার কথায়, ‘গত বছর দেড়েকে যেভাবে বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী কথাবার্তা বলার ধূম পড়েছে, তাতে এটা ছাড়া আমাদের কোনও উপায় ছিল না।’

‘হ্যাঁ, মানছি যে প্রত্যেক বিদেশি নাগরিকের বাকস্বাধীনতার অধিকার আছে, ভারতকে গালিগালাজ করারও নিশ্চয়ই অধিকার আছে— কিন্তু আমাদেরও পাল্টা এই অধিকার আছে যে কাকে ভিসা দেওয়া হবে আর কাকে দেওয়া হবে না, সেটা ঠিক করার’, আরও মন্তব্য করেন তিনি।

গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনার নাটকীয় পতনের পর থেকেই বাংলাদেশে ভারতের স্বাভাবিক ভিসা কার্যক্রম কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। খুব জরুরি কিছু মেডিক্যাল ভিসা ও ইমার্জেন্সি ভিসা ছাড়া ভারত বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়া একরকম বন্ধই করে দিয়েছিল বলা চলে।

কিন্তু এখন ধীরে ধীরে ভিসা দেওয়ার সংখ্যা আবার বাড়ানো হচ্ছে। ঢাকা এবং খুলনা, রাজশাহী, সিলেট ও চট্টগ্রামের মোট পাঁচটি ভিসা আবেদন কেন্দ্রের মাধ্যমে গত কয়েক মাসে আবার রোজ বেশ কয়েকশো করে ভিসা ইস্যু করছে ভারত। যদিও তা আগের পর্যায়ে এখনও আসেনি, কিন্তু এই সংখ্যাটা ধীরে ধীরে বাড়ছে।

ভারতের পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ভিসার সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি এটা নিশ্চিত করাও জরুরি হয়ে পড়েছে যে যারা প্রকাশ্যে ভারত-বিরোধী মন্তব্য ও পোস্ট করছেন তাদের যেন ভারতের ভিসা ইস্যু না করা হয়। সে কারণেই এই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

প্রসঙ্গত এটাও উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশ থেকে যে ছাত্রছাত্রীরা আইসিসিআর স্কলারশিপ নিয়ে ভারতে পড়াশুনা করতে আসেন বা সংস্কৃতি, বাণিজ্য, শিক্ষার মতো বিশেষ কিছু ক্যাটেগরিতে ভিসা নিয়ে আসেন— তাদের বেলায় সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট পরীক্ষা করার রেওয়াজ অনেকদিন ধরেই আছে। কিন্তু এবারে সেই রীতিটাই সাধারণ ভিসা আবেদনকারীদের জন্যও প্রযোজ্য হবে।

তবে এটাও জানা যাচ্ছে মূলত আঠারো থেকে ষাট বছর বয়সীদেরই এই সোশ্যাল মিডিয়া চেকের আওতায় আনা হবে, ছাড় পাবেন অপ্রাপ্তবয়স্ক ও প্রবীণরা। যারা মেডিক্যাল ভিসা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভারতে চিকিৎসা নিচ্ছেন ও সেই রেকর্ড আছে, তাদেরও রেহাই মিলবে।

মার্কিন ধাঁচে এটাও পরীক্ষা করা হবে, আবেদনকারী নিজের সব পোস্ট ‘পাবলিক’ করে রেখেছেন, নাকি কিছু আড়াল করতে চেয়েছেন।

ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের এক সাবেক রাষ্ট্রদূত এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে বলছিলেন, ‘আমি তো মনে করি এই ব্যবস্থা অনেক আগেই চালু করা দরকার ছিল। বাংলাদেশের মাটিতে বসে যারা নিয়মিত ভারতকে গালিগালাজ করেন, তাদের চিনে নেওয়ার এত সহজ একটা হাতিয়ার যখন আছে— ফলে সেটা ব্যবহার করে তারা ভিসার আবেদন করলে সেটা খারিজ করাই উচিত।’

কোভিড মহামারির ঠিক আগেও বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৯ লাখ বা তার বেশি ভিসা ইস্যু করতে ভারত। এখনও ভিসা দেওয়ার হার সেই পর্যায়ে না গেলেও এই বিপুল পরিমাণ আবেদনকারীর সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট পরীক্ষা করার মতো লোকবল বা প্রযুক্তিগত দক্ষতা ভারত সরকারের আছে কি-না, সেই প্রশ্ন অবশ্য রয়েই যাচ্ছে।

তবে ভারতের এক কর্মকর্তা জানাচ্ছেন, ধাপে ধাপে এই প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই শুরু করে দেওয়া হয়েছে— এবং এজন্য লোকবল ও কারিগরি দক্ষতাও বাড়ানো হচ্ছে। তবে ভারত এ নিয়ে এখনই কোনও আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় যেতে চাইছে না সহজবোধ্য কারণেই।

আন্তর্জাতিক বিভাগের আরো খবর

Link copied!