চলতি বছর এইচএসসির বাংলা প্রথম পত্র পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের একটি প্রশ্নে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ উঠেছে। পরীক্ষার সৃজনশীল প্রশ্নপত্রের ১১ নম্বর প্রশ্নে হিন্দুধর্মাবলম্বী দুই ভাইয়ের জমি নিয়ে বিরোধের বিষয় তুলে ধরা হয়, যা সাম্প্রদায়িক উসকানি বলে মনে করছেন দেশের শিক্ষাবিদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
প্রশ্নটিতে দেখানো হয়েছে, দুই ভাইয়ের জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে বড় ভাই গোপালকে শায়েস্তা করতে আব্দুল নামে একজন মুসলিম ব্যক্তির কাছে জমির একাংশ বিক্রি করে দেন নেপাল। জমি কেনা ব্যক্তি সেই জমিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন এবং কোরবানির ঈদে সেখানে গরু কোরবানি দেন। এতে জমি বিক্রেতা নেপালের মন ভেঙে যায়। তিনি জমিজমা সব ফেলে সপরিবার ভারতে চলে যান।
এদিকে আলোচিত প্রশ্নপত্রটি কুমিল্লা বোর্ডের জানিয়ে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলেও অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, সেটি ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের। রোববার (৬ নভেম্বর) সারা দেশে এইচএসসির বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষা হয়। ঢাকা বোর্ডের ‘কাসালাং’ সেটের নাটক সিরাজউদ্দৌলা অংশের ১১ নম্বর প্রশ্ন নিয়ে দেখা দিয়েছে এ বিতর্ক।
প্রশ্নের মধ্যে এমন সাম্প্রদায়িকতা চেতনা প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেটি ভাইরাল হয়ে যায়। একই সঙ্গে পরীক্ষার পর থেকেই এই নিয়ে নানা মহলে আলোচনার ঝড় চলছে।

কী আছে প্রশ্নে
প্রশ্নের উদ্দীপক অংশে বলা হয়, “নেপাল ও গোপাল দুই ভাই। জমি নিয়ে বিরোধ তাদের দীর্ঘদিন। অনেক সালিশ-বিচার করেও কেউ তাদের বিরোধ মেটাতে পারেনি। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। এখন জমির ভাগ-বণ্টন নিয়ে মামলা চলছে আদালতে। ছোট ভাই নেপাল বড় ভাইকে শায়েস্তা করতে আব্দুল নামে এক মুসলমানের কাছে ভিটের জমির এক অংশ বিক্রি করে। আব্দুল সেখানে বাড়ি বানিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। কোরবানির ঈদে সে নেপালের বাড়ির সামনে গরু কোরবানি দেয়। এই ঘটনায় নেপালের মন ভেঙে যায়। কিছুদিন পর কাউকে কিছু না বলে জমি-জায়গা ফেলে সপরিবারে ভারতে চলে যায় সে।”
শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা যা বললেন
কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জামাল নাছের বলেন, “কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের বাংলা বিষয়ের পরীক্ষার প্রশ্ন নিয়ে গণমাধ্যমে যে সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে, তা ভুল। রোববার অনুষ্ঠিত বাংলা বিষয়ের প্রশ্ন আমি মাননীয় মন্ত্রী, শিক্ষাসচিব মহোদয়কে পাঠিয়েছি। কারা এমন বিভ্রান্তি ছড়াল, তা আমার বোধগম্য নয়।”
অন্যদিকে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব কমিটির সভাপতি তপন কুমার সরকার জানান, প্রশ্নটি ঢাকা বোর্ডের।
ঘটনা ‘দুঃখজনক’ বলছেন শিক্ষামন্ত্রী
ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার (৭ নভেম্বর) আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এক অনুষ্ঠান শেষে আলোচিত এই প্রশ্নপত্র নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। যেভাবে সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়া হয়েছে, তাকে ‘দুঃখজনক’ হিসেবে বর্ণনা করে ‘উসকানিদাতাকে’ চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন তিনি।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “কী কী বিষয় মাথায় রেখে প্রশ্ন করতে হবে, তার স্পষ্ট নির্দেশিকা দেওয়া থাকে শিক্ষকদের। সাম্প্রদায়িকতার কিছু যেন না থাকে, সেটাও সেই নির্দেশিকায় আছে।” তিনি বলেন, “বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক দেশ। এই বাংলাদেশে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে সাম্প্রদায়িক উসকানির কোনো কিছু থাকলে এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। এটা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।”
দীপু মনি বলেন, “প্রশ্ন সেটিং আর মডারেটিং করা হয়। যিনি সেট করেন তিনি সেটা দেখতে পারেন না। যিনি মডারেট করেন তিনিও দেখার সুযোগ পান না। আর তাদের বাইরে আর কারও দেখার সুযোগ থাকে না। এটা আমাদের নির্দেশিকায় আছে।”
মন্ত্রী আরও বলেন, “খুবই দুঃখজনক যে কোনো একজন প্রশ্নকর্তা এই প্রশ্ন করেছেন। যিনি মডারেট করেছেন তার দৃষ্টিও এড়িয়ে গেছে। তিনিও এটিকে স্বাভাবিকভাবে নিয়েছেন। আমরা চিহ্নিত করছি এটা কে বা কোন মডারেটর করেছেন। আমরা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।”
দীপু মনি বলেন, “প্রশ্ন ফাঁস বন্ধে আমরা এত ব্যবস্থা নিয়েছি, যেখানে প্রশ্ন ছাপা হয় বা মডারেটর দেখেন বা কোশ্চেন সেটেল করেন। এই এক একটা ধাপ। আর এই ধাপের কোনো একটা জায়গায় বিচ্যুতি হলে সেটা কিন্তু ডিটেকটেড হয় পরীক্ষার হলে, যখন পরীক্ষার্থী প্রশ্নপত্র হাতে পায়। তার আগে প্রশ্ন দেখার কোনো সুযোগ নেই। সে জন্য এই সমস্যাগুলো থেকে যাচ্ছে। আমরা দেখছি এটা কীভাবে দূর করা যায়।”
তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, “এ ঘটনায় যারা চিহ্নিত হবেন, এবং যারা আমাদের শিক্ষার্থীদের মনে এই ধরনের বীজ বপন করবেন, তাদের এই ধরনের কার্যক্রমের সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত রাখার প্রশ্ন আসবে না।”
কী বলছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা
প্রশ্নপত্রে সাম্প্রদায়িকতা প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “একটি পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র করার সময় দায়িত্ব নিয়ে, নৈতিকতার সঙ্গে কাজ করতে হয়। প্রশ্নপত্রে এই রকম সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ড কখনো গ্রহণযোগ্য নয়। আমার মনে হয় এটা একটা অপরাধ। এমন কাজ কোনো শিক্ষকের করা উচিত নয়। এই বিষয়টি একটি নিন্দনীয় কাজ।”
ঘটনার নিন্দা জানিয়ে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আরও বলেন, “এ রকম কর্মকাণ্ডে শিক্ষক হিসেবে আমি নিজেও লজ্জিত। এই বিষয় শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হতে পারে না। এর সঙ্গে দায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। পাশাপাশি অভিভাবকদের প্রতিবাদ করার আহ্বান জানাচ্ছি।”
এ বিষয়ে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, “সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়ার জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি। যে বা যারা এই কাজটি করেছে, তা অবশ্যই নিন্দনীয় কাজ। এর আগেও এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে, যার কোনোটির সুষ্ঠু বিচার হয়নি বলেই এই কাজগুলো বারবার ঘটছে। এই ধরনের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সরাসরি একটি সম্প্রদায়কে হেয় করা হয়েছে, যা দ্রুত বিচার আইনে নিয়ে এসে বিচারের ব্যবস্থা করা উচিত।”

প্রশ্ন প্রণয়নকারী ও মডারেটর চিহ্নিত
পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক অংশের প্রশ্ন প্রণয়নকারী ও মডারেটরদের মঙ্গলবার (৮ নভেম্বর) চিহ্নিত করা হয়েছে। চিহ্নিতদের তালিকা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে দিয়েছে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড। বোর্ড জানিয়েছে, বাংলা প্রথম পত্রের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক প্রশ্নপত্রটি যশোর শিক্ষা বোর্ড প্রণয়ন করেছে। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করেছেন ঝিনাইদহের মহেশপুরের ডা. সাইফুল ইসলাম ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক প্রশান্ত কুমার পাল।
প্রশ্নপত্র মডারেট করেছেন নড়াইলের সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ তাজউদ্দিন শাওন, সাতক্ষীরা সরকারি মহিলা কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মো. শফিকুর রহমান, নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের সহকারী অধ্যাপক শ্যামল কুমার ঘোষ এবং কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা আদর্শ কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. রেজাউল করিম।