২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর দেয়ালে দেয়ালে উশকো খুশকো চুলের একটি গ্রাফিতি বেশ আলোচিত হয়েছিল। ‘সুবোধ’ নামের ওই গ্রাফিতি ঢাকায় ভিন্ন ভিন্ন সময়ে দেখা গেছে বিচিত্র রূপে। কখনো দেখা গেছে খাঁচায় বন্দি সূর্য নিয়ে সুবোধ ছেড়া প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে। জানান দিচ্ছে, ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, এখন সময় পক্ষে না’ বা ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা তোর ভাগ্যে কিছু নেই’।
সেই রহস্যময় সুবোধের দেখা মিলল রাজধানীর বাইরে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) পাশে।
সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ সড়কের ডানপাশে আখালিয়া এলাকায় অবস্থিত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এর পাশে রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সিলেট অঞ্চলের সদর দপ্তর। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে আধা কিলোমিটার দূরে তপোবন আবাসিক এলাকা পেরিয়ে বিজিবি গেটের বিপরীতে সড়কের পাশে করিম বকস নামক তামাক কোম্পানির সামনের দেয়ালে সুবোধের গ্রাফিতি দেখা যায়।
ওই গ্রাফিতেতে দেখা যায়, সুবোধ টেলিফোনে কথা বলছে। টেলিফোনের লম্বা একটি তার (ক্যাবল) আঁকা দেয়ালে। আর ওই তার একই দেয়ালের কয়েক ফুট দূরে ইংরেজীতে লেখা 'HOBEKI?'। 'O' বর্ণের সম্পূর্ণ অংশ লাল রঙে ভরাট করা।
করিম বকস নামক তামাক কোম্পানি কর্মচারী মো. হিরন বলেন, “এখানে কে বা কারা এই দৃশ্য এঁকেছে আমরা দেখিনি।”
এটি রাতে আঁকা হয়েছে জানিয়ে হিরন বলেন, “এটা আরও ৭ থেকে ৮ দিন আগের। গভীর রাতে আঁকা হয়েছে, তাই কে এঁকেছে সেটা কারও চোখে পড়েনি।”
এই স্থান থেকে আরও আধা কিলোমিটার এগিয়ে গেলে মাউন্ট এডোরার হাসপাতালের পাশের এলাকা নেহারীপাড়া রোডের একটি দোকানের দেয়ালে চোখে পড়ে আরেকটি গ্রাফিতি। ওই গ্রাফিতিতে দেখা যায়, অন্ধকারের মধ্যে থেকে সূর্যমূখী ফুল হাতে একটি হাত বের করার দৃশ্য। ওই এলাকার বাসিন্দারা জানান, গভীর রাতে এটি আঁকা হয়েছে। তাই কারা এঁকেছে তা তারা দেখেননি।
গ্রাফিতি দুটির সঙ্গে শাবিপ্রবিতে গত একমাস ধরে উপাচার্যের পদত্যাগের যে আন্দোলন চলছিল, সেই আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে বলে জানান শিক্ষার্থীরা। তবে কে বা কারা গ্রাফিতি দুটি এঁকেছে তা তারা জানেন না।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আবেদীন বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে রাতের আঁধারে কে বা কারা এই গ্রাফিতি এঁকেছে তা আমরা জানি না। তবে সুবোধের এই গ্রাফিতিটি আমাদের কাছে খুবই প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। আমাদের দাবি-দাওয়াগুলো মেনে নেওয়া হবে এমন আশ্বাস আমাদের দেওয়া হয়েছে।”
সুবোধের গ্রাফিতিটি গত ৪ থেকে ৫ দিন আগে এবং ফুলের গ্রাফিতিটি গত বৃহস্পতিবার শিক্ষার্থীদের চোখে পড়েছে বলে জানান শাহরিয়ার।
সুবোধের গ্রাফিতির ব্যাখ্যা জানতে চাইলে শাহরিয়ার আবেদীন বলেন, “যে ইংরেজি ‘O' বর্ণটি লাল রং দিয়ে ভরাট করা, সেটি দিয়ে উদীয়মান সূর্যকে বোঝানো হয়েছে। উপাচার্যের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে বহুল আকাঙ্ক্ষিত সেই সূর্য উঠবে কি না, সেটি বোঝাতেই লাল বৃত্ত আঁকা হয়েছে বলে ধারণা করছেন শাহরিয়ার আবেদীনসহ আরও অনেক শিক্ষার্থী।”
শাহরিয়ার বলেন, “আশ্বাস নিয়ে আমরা এখনও বসে আছি এবং সুবোধের মতো আমাদের মনেও মাঝে-মধ্যে ওই প্রশ্নটি জাগে- ‘হবেকি?’। আমাদের দাবি-দেওয়া মেনে নেওয়া হবে কি না, মনে এমন প্রশ্নের উদয় হয় সবসময়। তাই গ্রাফিতিকে প্রাসঙ্গিক বলে মনে হচ্ছে।”
‘অন্ধকার থেকে বাইরে সূর্যমুখী ফুল হাতে’ এই গ্রাফিতির ব্যাখ্যা করে শাহরিয়ার বলেন, শিক্ষার্থীরা দাবি আদায়ের জন্য উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করে অহিংস আন্দোলন করছিলেন। ওই সময় পুলিশ উপাচার্যকে উদ্ধার করার নামে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ ও লাঠিপেটা করেছিল। কিন্তু আমরা শিক্ষার্থীরা পুলিশ সদস্যদের ফুল দিয়ে ক্যাম্পাস ত্যাগ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলাম। ফুল দিয়ে শান্তির আহ্বান করা হয়েছিল। নতুন এই গ্রাফিতি ঠিক ওইদিনের চিত্রই তুলে ধরেছে বলে ধারণা করছি।”
গত মাসে শাবিপ্রবিতে বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রভোস্টের অসদাচরণের অভিযোগে আন্দোলনে নামেন ওই হলের ছাত্রীরা। দাবি আদায় না হওয়ায় শাবি উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে অবরুদ্ধ করেন শিক্ষার্থীরা। এর জেরে পুলিশের হামলার শিকার হয়ে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে টানা ২৬ দিন আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা। চলে আমরণ অনশন। পরে শিক্ষামন্ত্রীর আশ্বাসে আন্দোলন প্রত্যাহারের ৪দিন পর শিক্ষার্থীরা সুবোধের গ্রাফিতি সড়কের পাশের দেয়ালে লক্ষ্য করেন। এতে তারা তাদের দাবি পূরণ হবে এমন আশায় প্রহর গুনছেন।
সুবোধ হলো একটি প্রতীকী চিত্র বা গ্রাফিতি। এটি এমন একটি দেয়ালচিত্র, যেটি আঁকতে স্টেন্সিল এবং স্প্রে পেইন্ট ব্যবহার করা হয়। এতে রাজনীতিসহ সমাজের নানা বিষয়কে খোঁচা দেওয়ার প্রবণতা যেমন দেখা যায়, তেমনি সম্ভাবনাময় কোনো কিছুও তুলে ধরা হয়। ঢাকার বিভিন্ন দেয়ালের পর বর্তমানে সিলেটের দেয়ালচিত্রেও সেটি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। চিত্রশিল্পীরা সুবোধকে কোন উদ্দেশে এঁকেছেন, তা একমাত্র তারা বা তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজন জানেন। এর সঙ্গে শাবিপ্রবির আন্দোলনের কোনো সম্পৃক্ততা আছে না কি স্থানীয় অন্য কোনো সূত্র আছে, তা এখন পর্যন্ত সবার কাছে অজানাই রয়েছে।