• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ২২ শাওয়াল ১৪৪৫

গোলপোস্ট হয়ে ওঠে মৃত্যুর পটভূমি


ফেনী প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৩, ২০২২, ০৩:৩১ পিএম
গোলপোস্ট হয়ে ওঠে মৃত্যুর পটভূমি

মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ও ইতিহাসখ্যাত নীরব সাক্ষী ফেনী সরকারি কলেজের বধ্যভূমি। একাত্তর-পরবর্তী সময়ে বধ্যভূমি থেকে শত শত কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়েছিল। তাই নতুন প্রজন্মকে জানান দিতে এবং ইতিহাস সংরক্ষণে নির্মাণ করা হচ্ছে কোটি টাকা ব্যয়ে দৃষ্টিনন্দন, আধুনিক স্মৃতিস্তম্ভ।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনারা ফেনী কলেজে গড়ে ছিল আর্মি ক্যাম্প। আশপাশের জেলা, থানা থেকে স্বাধীনতাকামী নিরীহ মানুষকে ধরে এনে মাঠে গোলপোস্টে ঝুলিয়ে রাইফেলের বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও গুলি ছুড়ে হত্যা করে পাশেই পুঁতে ফেলত। এ ছাড়া বহু মা-বোনের ইজ্জত নষ্ট করে এখানেই নির্মমভাবে হত্যা করা হতো। পরবর্তী সময়ে দেশ স্বাধীনের পর বহু মানুষ স্বজনের খোঁজে কলেজ ক্যাম্পাসে ভিড় করেছিলেন। বর্তমানে এখানে একটি বধ্যভূমি থাকলেও যথাস্থানে তা নির্মাণ হয়নি। তাই স্মৃতি সংরক্ষণে নতুন করে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ফেনীতে এসেছিল প্রতীক্ষিত ‘মুক্তি’। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ফেনীতে উদিত হয়েছিল স্বাধীনতার প্রথম সূর্য। এই দিন সকাল থেকে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা ২ নম্বর সাব সেক্টর কমান্ডার ও দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা অধিনায়ক লে. কর্নেল জাফর ইমামের (তৎকালীন ক্যাপ্টেন, বীরবিক্রম) নেতৃত্বে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে দলে-দলে উচ্ছ্বসিত জনতা লাল-সবুজের পতাকা হাতে নিয়ে চারদিক থেকে ফেনী শহরে প্রবেশ করেন। মুক্ত ফেনীতে মানুষের দৃষ্টি ছিল ফেনী কলেজে। এক দিন আগে পাকিস্তানি আর্মি কলেজ ক্যাম্পাস ছেড়ে দেয়। এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ ক্যাম্প ও বহু শহীদের রক্তে রঞ্জিত বধ্যভূমি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ফেনী কলেজের তৎকালীন দর্শন বিভাগের শিক্ষক মুজিুবর রহমান বলেন, “মাঠের একদম দক্ষিণের গোলপোস্টের নিচে অনেক লাশ পেয়েছি। এক কোণে ২০-২৫টি লাশ দেখেছি। ঢাকা থেকে সাংবাদিকরা এসে ছবি তুলেছেন। কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে তার সঠিক তথ্য নেই। তবে এখানে অসংখ্য মানুষকে ধরে এনে হত্যা করেছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। গোলপোস্টের পেছনের অংশ ছাড়াও মাঠ লাগোয়া রেলওয়ের ডোবাতেও অনেক মৃতদেহ পচে-গলে ছিল। এখন যেখানে অডিটরিয়াম রয়েছে সেখানেও মানুষের কঙ্কাল মিলেছিল।”

বধ্যভূমি প্রসঙ্গে ফেনী ইউনিভার্সিটির ডেপুটি রেজিস্ট্রার শাহ আলম বকুল বলেন, “তখন স্কুলে পড়ি। ৬ ডিসেম্বর সকালে মানুষ ছুটছিল ফেনী কলেজের পেছনের অংশে। তাদের দেখে আমিও ছুটলাম। কিন্তু ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা কলেজের ভেতরের মাঠে ঢুকতে দিচ্ছিল না। তখন মাস্টারপাড়ার ভেতর দিয়ে কলেজের পেছন দিক দিয়ে ঢুকি। দেখতে পাই, মাঠের দক্ষিণ গোলপোস্টে ফাঁসির দড়ি ঝুলে আছে। ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো পড়ে আছে। তীব্র পচা গন্ধে কাছে যাওয়া কষ্টকর হচ্ছিল। এখানে অনেককে ঝুলিয়ে নির্যাতন করে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল বলে শুনেছিলাম। মুক্তিকামী মানুষদের ধরে এনে বাঘের খাঁচায় ঢুকিয়ে হত্যার কথাও শুনেছিলাম।”

বধ্যভূমি প্রসঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মোতালেব বলেন, “যুদ্ধ শেষে কলেজের ভেতরের অংশে অসংখ্য মানুষের হাড়গোড় পাওয়া যায়। তবে কাদের এখানে এনে হত্যা করা হয়েছে তা অজানা।”

ফেনী কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ, ফেনী ইউনিভার্সিটির কোষাধ্যক্ষ বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক তায়বুল হক বলেন, “জানুয়ারির শুরুতে কলেজের বর্তমান শহীদ মিনারের বেদির পাশে মানুষের হাড়গোড়-খুলি দেখেছি। ‘হাড়গোড় সম্পর্কে একটি সত্য ঘটনা রয়েছে। এক দিন এক ব্যক্তি শহীদ মিনার বেদিতে এসে একটি খুলি নিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। এটি দেখে দায়িত্বরতরা তাকে গতিরোধ করলেন। সোনাগাজী থেকে আসা ওই ব্যক্তি বলছিলেন, খুলিটি আমার ভাইয়ের। যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদাররা আমার ভাইকে ধরে এখানে নিয়ে এসেছিল। এরপর আর সে ফিরে যায়নি। আমার ভাইয়ের মাথা বড় ছিল। এ খুলিটি আকারে বড়। এটি আমার ভাইয়ের মাথা।’”

জেলা প্রশাসক আবু সেলিম মাহমুদ-উল হাসান বলেন, “বধ্যভূমি সংরক্ষণের জন্য ফেনী কলেজে স্মৃতিস্তম্ভ করা হচ্ছে। এটি বাস্তবায়ন হলেই ফেনীর একটি নতুন ইতিহাস গড়ে উঠবে। একই সঙ্গে আগামী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধে ফেনীর ইতিহাস সংরক্ষিত ও সমৃদ্ধ হবে।”

ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী বলেন, “মুক্তিযুদ্ধ আবেগের বিষয়। ইতিহাস ধরে রাখতে বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ প্রকল্পটি আগামী স্বাধীনতা দিবসের আগেই উদ্বোধন করার পরিকল্পনা রয়েছে জানান প্রকল্পটি নির্মাণের উদ্যোক্তা।”

পৌনে তিন কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিস্তম্ভটি উদ্বোধন হবে ২৬ মার্চের আগেই।

একাত্তরের ২৩ এপ্রিল। ফেনীর তিন দিক থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢুকে পড়ে। পতন হয় ফেনীর। ফেনী পাইলট হাইস্কুল ও কলেজ হয়ে পড়ে তাদের প্রধান ঘাঁটি। সেখানে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধরে নিয়ে আসা হতো সাধারণ নারী-পুরুষদের। স্কুল ও কলেজের শ্রেণিকক্ষগুলো একেকটা হয়ে উঠত টর্চার সেল। দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনি হতো নির্যাতিতদের আর্তনাদ। বাতাস ভারী হয়ে উঠত তাদের চিৎকারে। পাকিস্তানি সৈন্যরা ছিল নিষ্ঠুর, নির্মম ও রক্তলোলুপ। কলেজের মাঠে ফেনীর ছাত্র-শিক্ষক শ্রমিক ও নিরীহ মেহনতি মানুষদের ঝুলিয়ে চালাত নিযার্তন। পরে নির্বিচারে গুলি করে মারত। খুব ঠান্ডা মাথায় মাঠে পুঁতে ফেলত। কলেজ মাঠের দক্ষিণ গোলপোস্টকে বানিয়েছিল ফাঁসিকাস্ট। একটা সাধারণ গোলপোস্ট পাকিস্তানি হায়নাদের হাতে পড়ে হয়ে গেল মৃত্যুর জলজ্যান্ত বিভীষিকার পটভূমি। গোলপোস্ট হয়ে গেল ফাঁসির মঞ্চ। পাকিস্তানিদের এ নারকীয় পৈশাচিকতার দাগ ফেনীর মাটি থেকে কখনো মুছবে না।

ফেনী কলেজ বধ্যভূমির ঘটনা প্রবাহ নিয়ে আসাদুল ইসলামের রচনায় আবুল কালাম আজাদের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় পরিবেশ থিয়েটারের নাটক ‘গোলপোস্ট’। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালেয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগের তত্ত্ববধানে ফেনী জেলা শিল্পকলা একাডেমির ব্যবস্থাপনায় ২০২১ সালের ৭ নভেম্বর ‘গোলপোস্ট’ নাটকটি ফেনী সরকারি পাইলট হাইস্কুল মাঠে মঞ্চস্থ হয়। ফেনী কলেজের মূল ভবনটিকে বানানো হয় নাটকের সেট। স্কুল মাঠের গোলপোস্টকে ঘিরে চমৎকারভাবে নাট্যকর্মীরা দুর্দান্ত অভিনয়ে ফুটিয়ে তোলেন বধ্যভূমি গল্পের আদ্যোপান্ত।

 

Link copied!