• ঢাকা
  • রবিবার, ১২ মে, ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ৩ জ্বিলকদ ১৪৪৫

লোডশেডিংয়ে তাঁত কারখানা বন্ধের উপক্রম


আরিফ আহমেদ সিদ্দিকী, পাবনা
প্রকাশিত: অক্টোবর ২০, ২০২২, ০৯:৪৬ এএম
লোডশেডিংয়ে তাঁত কারখানা বন্ধের উপক্রম

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, ঘনঘন লোডশেডিং আর সুতাসহ তাঁতশিল্পের নানা উপকরণের দাম বৃদ্ধির কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে পাবনার তাঁতপল্লিগুলো। তাঁত এলাকায় আগের মতো খট খট শব্দ নেই। বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে গেছে কারখানাগুলো।

তাঁতিরা কারখানায় উৎপাদন সচল রাখতে ডিজেলচালিত জেনারেটর ব্যবহার করছেন। কিন্তু ডিজেলের দাম বাড়ায় লুঙ্গি-গামছা তৈরিতে অতিরিক্ত টাকা ব্যয় হচ্ছে। সেই তুলনায় পণ্যের দাম না পাওয়ায় কারখানা সচল রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। ঊর্ধ্বমুখী দ্রব্যমূল্যের এই বাজারে বেকার শ্রমিকেরা পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

পাবনা তাঁতসমৃদ্ধ জেলা হিসেবে পরিচিত। জেলার ৯ উপজেলার মধ্যে পাবনা সদর, সাঁথিয়া, সুজানগর, বেড়া, ফরিদপুর উপজেলার জালালপুর নতুনপাড়া, দোগাছি, মাসুমদিয়া, কুড়িপাড়া, গোপালপুর, একদন্ত, শিবপুর চাচকিয়া, আতাইকুলা, বনগ্রাম, হাতিগাড়া, হাটুরিয়া, জগন্নাথপুর, পেঁচাকোলা, রাকশা, বাটিয়াখরা, সোনাতলা, ছেচানিয়া, ডহরজানি, ডেমরা, নাগডেমরা, পার ফরিদপুর, বনওয়ারিনগর, আমিনপুরসহ বিভিন্ন এলাকা তাঁতশিল্পের জন্য বিখ্যাত। তাঁতশিল্পকে কেন্দ্র করে আতাইকুলায় বিশাল কাপড়ের হাট গড়ে উঠেছে।

বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের পাবনার সাঁথিয়া বেসিক সেন্টারের লিঁয়াজো অফিসার বাসুদেব দাস বলেন, “এখন জেলায় চালু হস্তচালিত তাঁত এবং বিদ্যুৎচালিত পাওয়ার লুমের সংখ্যা ২০ হাজারের মতো। বিদ্যুৎচালিত তাঁত কারখানাগুলোতে সুতা তৈরি, রং দেওয়া, সুতা শুকানো, নলিভরা ও কাপড় উৎপাদনের জন্য প্রতি তাঁতে গড়ে ৩-৪ জন নারী-পুরুষ শ্রমিক কাজ করেন। এই তাঁতশিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছে প্রায় ৩ লাখ মালিক-শ্রমিক পরিবারের ১৩ লাখ লোকের জীবন-জীবিকা।”  

কুলুনিয়া গ্রামের গ্রামের তাঁত কারখানা মালিক সৈয়দ আলী বলেন, “ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে ডিজেলচালিত জেনারেটর দিয়ে কারখানা চালু রাখা হতো। কিন্তু সরকার ডিজেলের দাম বৃদ্ধি করায় জেনারেটর চালানো যাচ্ছে না। ৪-৫ ঘণ্টা জেনারেটর চালু রাখলে ১০-১২ লিটার তেল প্রযোজন হচ্ছে। এই কয়েক ঘণ্টার জন্য অতিরিক্ত দেড় হাজার টাকা খরচ হয়। এতে উৎপাদন খরচ বেড়েছে অনেক বেশি।”

একই গ্রামের সুতা ব্যবসায়ী কামাল ব্যাপারী বলেন, “৫০ কাউন্টের এক বেল সুতা এক বছর আগে ছিল সাড়ে ১৪ হাজার টাকা, এখন সেই সুতার দাম ২২ হাজার ২০০ টাকা। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেক ক্ষুদ্র তাঁতী, নারী ও পুরুষ-শ্রমিক কাজের সন্ধানে চলে গেছেন ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, চিটাগাংয়ে। সেখানে অনেকই গার্মেন্টসে কাজ করছেন। আবার কেউ কেউ রিকশা-ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।”

এ ছাড়া লোডশেডিং, সুতাসহ অন্যান্য উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় তাঁতিদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। সাঁথিয়া উপজেলার সোনাতলা গ্রামের তাঁত শ্রমিক রহম আলী, আব্দুল কদ্দুস ও আব্দুল জব্বার বলেন, “আগে একজন শ্রমিক সপ্তাহে তিন-চার হাজার টাকার কাজ করত। এখন এক থেকে দেড় হাজার টাকার কাজ করা হচ্ছে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার কারণে দিনে ও রাতে বেকার বসে থাকতে হচ্ছে। এ কারণে ঠিতমতো কাজ হচ্ছে না। আয়ও কমেছে, সংসার চালাতে সমস্যা হচ্ছে।”

বেড়া উপজেলার তাঁতি আবুল হোসেন বলেন, “জেলায় বারবার লোডশেডিং হওয়ায় এবং একই সঙ্গে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় অধিকাংশ তাঁত কারখানা এখন বন্ধ হতে চলেছে। যেখানে ১০ জন শ্রমিক কাজ করতেন, লোডশেডিংয়ের কারণে বর্তমানে সেখানে তিনজন শ্রমিক কাজ করছেন। এতে উৎপাদন কম হচ্ছে। আবার যতটুকু উৎপাদিত হচ্ছে, সেগুলো মূল্যবৃদ্ধির কারণে হাটবাজারে বিক্রি হচ্ছে না।”

পাবনা সদর উপজেলার আকবর আলী জানান, প্রায় এক যুগ ধরে তাঁতের শ্রমিক হিসেবে কাজ করে ১০ জনের সংসার চালান। কাজ যতই কম থাকুক না কেন, প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে দুই থেকে তিন হাজার টাকা বিল পেতেন। এখন লোডশেডিংয়ের কারণে তা-ও রোজগার হচ্ছে না।

সুজানগর উপজেলার লুঙ্গি তৈরির শ্রমিক আবুল কাশেম জানান, আগে দিনে পাঁচ-ছয়টি তৈরি করা যেত। লোডশেডিংয়ের কারণে এখন সারা দিনে তিনটি লুঙ্গি তৈরি করা যায় না। গত বছরের এই সময়ে একজন শ্রমিক সপ্তাহে তিন থেকে চার হাজার টাকার কাজ করত। এখন এক থেকে দেড় হাজার টাকার কাজ করা যাচ্ছে।

একাধিক তাঁতির সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেন, “সারা দিনে চার থেকে পাঁচবার বিদ্যুৎ চলে যায়। একবার বিদ্যুৎ চলে গেলে এক ঘণ্টার আগে আসে না। রাতে আবার তিনবার লোডশেডিং হয়। রাতে বিদ্যুৎ গেলে টানা দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত পাওয়া যায় না।”

জেলায় দুটো পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি আছে। পাবনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর জেনারেল ম্যানেজার মো. আকমল হোসেন বলেন, “তার এরিয়ায় দিনের বেলায় প্রয়োজন হয় ৫৫ থেকে ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। আর সেখানে পাওয়া যাচ্ছে ৪৬ থেকে ৪৮ মেগাওয়াট। এ ছাড়া রাতে প্রয়োজন হয় ৮২ থেকে ৮৩ মেগাওয়াট, সেখানে পাওয়া যাচ্ছে ৬৫ থেকে ৬৬ মেগাওয়াট।”

পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর জেনারেল ম্যানেজার মো. মজিবুল হক জানান, তার এরিয়ায় দিনের বেলায় প্রয়োজন হয় ৬০ মেগাওয়াট। পান ৫২ থেকে ৫৪ মেগাওয়াট। রাতে দরকার হয় ৯০ মেগাওয়াট। পাওয়া যায় ৭০ থেকে ৭১ মেগাওয়াট। ফলে স্বাভাবিকভাবে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

তাঁতশিল্পকে কেন্দ্র করে পাবনার আতাইকুলা হাট গড়ে উঠেছে। হাটে অবস্থিত বিভিন্ন ব্যাংক, কাপড় ব্যবসায়ী ও  কারখানা মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আতাইকুলা হাটে প্রতি সপ্তাহে দুই দিন করে কাপড় বিক্রি হয়ে থাকে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কাপড় ব্যবসায়ী ও দোকান মালিকেরা এই হাটে এসে শাড়ি-লুঙ্গি ক্রয় করে থাকেন। ভারতের ব্যবসায়ীরা এসব হাট থেকে কিনে থাকেন। প্রতি হাটে ব্যাংক ও নগদসহ মোটা টাকার লেনদেন হতো। বর্তমানে কাপড় ক্রয়-বিক্রয়, রপ্তানি ও ব্যাংক লেনদেন প্রায় ৭০ শতাংশ কমে গেছে।  

পাবনা জেলা তাঁতি সমবায় সমিতির সভাপতি কামরুল আনান রিপন বলেন, “লোডশেডিং ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় অধিকাংশ সময় কারখানায় উৎপাদন বন্ধ থাকছে। এই শিল্পকে বাঁচাতে দ্রুত সরকারকে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।”

Link copied!