• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫

নরসিংদীতে ৭ দিনব্যাপী বাউল মেলা শুরু


নরসিংদী প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২৪, ০৩:২৮ পিএম
নরসিংদীতে ৭ দিনব্যাপী বাউল মেলা শুরু

নরসিংদী শহরের কাউরিয়াপাড়া এলাকায় মেঘনা নদীর তীর ঘেঁষে শ্রী শ্রী বাউল ঠাকুরের আখড়া ধামে শুরু হয়েছে বাউল মেলা। বাউল সম্প্রদায়ের নিয়ম অনুযায়ী প্রায় ৭০০ বছর ধরে মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে এখানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই মেলা।

শনিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) মহাযজ্ঞের মাধ্যমে শুরু হয় মেলার আনুষ্ঠানিকতা, চলবে আগামী শুক্রবার পর্যন্ত। মেলায় ভারতসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা কয়েক শত বাউল সাধক যোগ দিয়েছেন। বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে মানব ধর্ম ও সাম্যের জয়ধ্বনী করছেন বাউলরা।

দেশ-বিদেশের ভক্তদের উপস্থিতিতে বাউল ঠাকুরের আঁখড়া পরিণত হয় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল ধর্মাবলম্বীদের মিলনমেলায়। আত্মশুদ্ধি আর আত্মমুক্তির জন্য মেলা থেকে বাউলরা তুলে ধরছেন মানব প্রেমের গান।

বাউল ঠাকুরের আখরা ধাম সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছরই মাঘী পূর্ণিমার দিনে শ্রী চৈতন্য দেবের জন্ম তিথী উপলক্ষে মহাযজ্ঞের আয়োজনের মাধ্যমে শুরু হয় মেলার আনুষ্ঠানিকতা। প্রায় ৭শত বছরের ঐতিহ্যবাহী এই মেলাকে ঘিরে নরসিংদীর কাউরিয়া পাড়া এলাকার মেঘনা নদীর তীরে সমাগম ঘটে লক্ষাধিক নারী-পুরুষের। নদীতে চলে পূণ্যস্নান। পাশেই রয়েছে বাউল ঠাকুরের আঁখড়া। যেখানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বাউল শিল্পিরা এসে বসিয়েছে বাউল গানের আসর। এদিকে ভক্তরা সারি বেঁধে মহাযজ্ঞানুষ্ঠানে ফল-ফলাদী, ঘি-প্রদীপ, মোমবাতি ও আগরবাতি জ্বালিয়ে পূজা দেয় আর প্রার্থনা করে পরিবার ও দেশের সবার কল্যাণসহ যত ধরনের অশুভ শক্তি, অসাম্প্রদায়িকতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে নিস্কৃতি পেতে।

রোববার (২৫ ফেব্রুয়ারি) বাউল ঠাকুরের আখড়াবাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দেশ-বিদেশের কয়েকশ বাউল সাধক দলবেঁধে যোগ দিয়েছেন মেলায়। আটচালা বৈঠক ঘরে বসিয়েছে গানের আসর। কারো হাতে কর্তাল, কারো হাতে খমক, ঢোল বাজিয়ে বাজনার তালে তালে তুলে ধরছেন মানব প্রেমের গান। মূলত আত্মশুদ্ধি ও আত্মমুক্তির বিশ্বাস থেকেই এই মেলায় সমাগম ঘটে বাউল ভক্তদের।

বাউল ভক্ত তিশা বাউল বলেন, এখানে সকল জীবের কল্যাণের জন্য পূজা করা হয়। আমাদের দেহ পঞ্চভূতের তৈরি। প্রতিটা জীবে পরমাত্মা বিরাজ করে। সেই পরমাত্মাকে পূজা করার জন্যই আমরা এখানে মিলিত হই মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে। বাউল সাধকরা প্রত্যেকদিনই এই বিশ্বাসে পরমাত্মার পূজার্চণা করে থাকে। তবে মাঘী পূর্ণিমার দিনে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাউল সাধকরা এই আখড়াধামে মিলিত হয়ে মহাযজ্ঞের মাধ্যমে তা আরও বিস্তর আকারে পর্যালোচনা করে। আমাদের বিশ্বাস প্রত্যেকটা জীবেই পরমাত্মা বিরাজ করে। আর আমরা যদি এই পরমাত্মার আরাধনা করতে পারি, তবে আমরা পুনরায় মানুষ রূপে জন্মগ্রহণ করে জগৎ কল্যাণে কাজ করতে পারব। এটাই বিশ্বাস বাউল সাধকদের।”

পলাশ থেকে আসা ভক্ত ঠাকুরদাস দেবনাথ বলেন, “প্রায় ৭শত বছর আগে বাউল ঠাকুর এখানে এসেছিলেন। তার দেখানো মতাদর্শকে ধারণ করে প্রতি বছর এখানে এসে আরাধনা করি, মানব প্রেমের গান গাই। এখানে দেহতত্ত্ব, মহাজনী, মুর্শিদি, ফকিরি, গুরু ভক্তিসহ সব ধরনের সাধনার গান গাওয়া হয়ে থাকে। গানের মাধ্যমে মানব জীবনের সকল ভুল ভ্রান্তি দূর করে পুনরায় মানব জীবন প্রাপ্তির জন্য সাধনা করা হয়।”

ভারতের আগরতলা থেকে আসা বীনা দাস বলেন, “শত শত বছর পূর্বে ঠাকুর এখানে বর্তমান ছিলেন। এখন তিনি স্ব-শরীরে এখানে নেই তবে এই পবিত্র স্থানে ওনার আশির্বাদ আছে। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল জীবের জন্য এখানে আরাধনা করা হয়। আমরা প্রতি বছর দলবেঁধে ঠাকুরের আশিষ লাভের জন্য সমাবেত হই।”

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা আরেক ভক্ত বলেন, “বাংলাদেশের নরসিংদী এখানে ঠাকুরের স্থান। আমরা ১০ জন গুরু ভাই এখানে মাঘী পূর্ণিমা তিথিকে ঠাকুরের আরাধনার জন্য এসেছি। এখানে প্রচুর ভক্তের সমাগম হয়। মনের আশা পূরণের লক্ষ্যে ভক্তরা ঠাকুরে উদ্দেশ্যে মোমবাতি ও আগরবাতি জ্বালিয়ে পূজা দিচ্ছে আর মানব কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করছে।”

বাউল আখড়া ধামের সেবায়েত শ্রী স্বপন কুমার বাউল বলেন, “প্রায় ৭০০ বছর ধরে মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে বাউল মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। চলে সপ্তাহব্যাপী। পূর্ণিমার দিন মহাযজ্ঞের মাধ্যমে মেলার শুরু হয়। ভক্তরা ফল-মূল, মোমবাতি, ঘি- প্রদীপ ইত্যাদি অর্পণ করে পরিবারের কল্যাণ, জগতের কল্যাণ তথা সকল জীবের মুক্তির জন্য প্রার্থনা করেন।”

তিনি আরও বলেন, “বাউল শিল্পরা বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে মানব প্রেমের গান গেয়ে যায়। গানে গানে আত্মমুক্তি ও আত্মশুদ্ধির কথা তুলে ধরেন। দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই দিনে হাজারো বাউল ভক্তের সমাগম ঘটে। পূর্ণিমা যে দিনই পরুক সপ্তাহের বুধবার ভক্তদের মাঝে প্রসাদ বিতরণ করা হয়। এখানে সকল ধর্মের লোক মিলিত হয়ে প্রসাদ গ্রহণ করেন।”

এদিকে মেলাকে ঘিরে মেঘনা নদীর পার ঘেষে জমে উঠেছে মুখরোচক খাবার, খেলনা, কুটির শিল্প, মৃৎশিল্প, কাঠ-বাঁশ ও মাটির তৈরী কুটির শিল্প সামগ্রীর হরেক রকম দোকানের পসরা। এছাড়াও শিশুদের আকৃষ্ট করতে মেলায় বসেছে পুতুল নাচ, নাগর-দোলাসহ নানা বিনোদন মূলক রাইড।

জানা যায়, এ আখড়ায় বাউল ঠাকুরের অন্তর্ধান হয়েছিল। বাউল আখড়ায় জগন্নাথ দেবতার মন্দির রয়েছে। মন্দিরে মহাবিষ্ণুর পূর্ণাঙ্গ প্রতিমা, জগন্নাথ দেবতার প্রতিমা, মা গঙ্গার (৩৩ কোটি দেবতার) গট, নাগ দেবতার বিগ্রহ ও শিবলিঙ্গ রয়েছে, যা বাউল ঠাকুর নিজে প্রতিস্থাপন করে গেছেন বলে কথিত রয়েছে। পাশে রয়েছে বাউল ঠাকুর ও মাতাজির সমাধি মন্দির। সবার মধ্যিখানে রয়েছে উপাসনার জন্য বিশাল আটচালা বৈঠক ঘর। শনিবার দেবতা ব্রহ্মার পূজা মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। মহাযজ্ঞে জগতের কল্যাণের জন্য ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের পূজা করা হয়। ঠাকুরের কাছে দেশ ও মানুষের কল্যাণে প্রার্থনা করা হয়।

Link copied!