নাটোরের সিংড়া উপজেলার ১০নং চৌগ্রাম ইউনিয়নে রয়েছে একটি আর্দশ গ্রাম। যার নাম হুলহুলিয়া। গ্রামটি নিজস্ব নিয়ম-নীতি ও বিচারব্যস্থা দিয়ে পরিচালিত হয়। তাই কখনো প্রয়োজন হয়নি আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হস্তক্ষেপ।
আর্দশ গ্রাম খ্যাত হুলহুলিয়ায় গত ১০০ বছরে কোনো মামলা-মোকদ্দমার জন্য পুলিশকে যেতে হয়নি। কারণ নিজেদের নিয়ম নীতিতে বেশ কঠোর অবস্থানে রয়েছে এই গ্রাম।
নাটোর জেলা সদর থেকে ৩৭ কিলোমিটার এবং সিংড়া উপজেলা থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হুলহুলিয়া গ্রাম। গ্রামটি ১২টি পাড়া নিয়ে গঠিত। এই গ্রামের আয়তন প্রায় ২ বর্গকিলোমিটার। গ্রামের জনগণ সবাই শতভাগ শিক্ষিত।
-20210803100724.jpg)
শিক্ষা ও স্যানিটেশনের সুব্যবস্থার হারও প্রায় শতভাগ। গ্রামটি বাল্যবিবাহ, মাদক ও যৌতুকমুক্ত। এজন্যই এই গ্রামটিকে সরকার আদর্শ গ্রাম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
এই আর্দশ গ্রামে প্রবেশ করতে গেলে প্রথমেই চোখে পড়ে গ্রামের প্রবেশমুখে বিশাল একটি গেট। যেখানে লেখা রয়েছে 'আদর্শ গ্রাম হুলহুলিয়া'। ২০১০ সালে স্থানীয় সাংসদ তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এই গেটটি স্থাপন করেন।
গ্রামটি পরিচালনা করার জন্য নিজস্ব সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ নামে একটি কমিটিও রয়েছে। এই কমিটিতে একজন চেয়ারম্যান ও একজন ভাইস চেয়ারম্যানসহ মোট ২১ জন সদস্য এবং ৫ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটিও রয়েছে। যারা সবাই গ্রামের পুরুষ ভোটারদের দ্বারা দুই বছরের জন্য নির্বাচিত হন। ২ বছর পর পর ভোটের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠন করেন গ্রামবাসী।
এ গ্রামে একটি প্রাইমারি স্কুল, একটি হাইস্কুল, একটি মাদ্রাসা ও একটি মসজিদ রয়েছে। গ্রামটি থেকে ২ শতাধিক বিএসসি প্রকৌশলি বেরিয়ে এসেছেন। এছাড়াও শতাধিক এমবিবিএস ডাক্তার, ১৭ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ১১ জন বিচারকসহ নানা পেশার মানুষ এই গ্রামেরই বাসিন্দা।
গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমাদের গ্রামে এসএসসি পাশ করা বাধ্যতামূলক। এসএসসি পাশের আগে কেউ মেয়ে বিয়ে দিতে পারবে না। যদি কেউ কোনো কারণে তার

মেয়েকে ১৮ বছরের আগে বিয়ে দিতে চায়, কেন বিয়ে দিতে চাচ্ছে তা জেনে সমাধান করা হয়। বিয়ের সময় যৌতুক নেওয়া এবং দেওয়াও এখানে সম্পূর্ণ নিষেধ।“
দেশের অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব এই গ্রামেরই বাসিন্দা। এদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশের পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার মরহুম মোহাম্মদ হানিফ উদ্দিন মিয়া।
সম্প্রতি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার তার স্মরণে ডাক অধিদপ্তরের স্মারক ডাকটিকিট অবমুক্ত করেন। এছাড়া তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে হুলহুলিয়া গ্রামে ডিজিটাল হাব স্থাপন করা হয়েছে। মোস্তফা জব্বার নিজে গিয়ে সেই ডিজিটাল হাবের উদ্বোধন করেন।
এছাড়া গুণী ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন আইন বিভাগের সাবেক সচিব মরহুম একে কাদের তালুকদার, বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মির্জা মনজুরুল কাদের জুয়েল, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম এমএম রহমতুল্লাহ ও নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন ইঞ্জিনিয়ার জমসেদ আলী।
-20210803100640.jpg)
এই গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেন্টাল ইউনিটের চেয়ারম্যান ডা. মাহবুবুর রহমান, অস্ট্রেলিয়ার সিডনির সেন্ট্রাল হাসপাতালের ডিন ড. মন্টু তালুকদার ও কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারের পরিচালক ড. জিল্লুর রহমান।
২০১৬ সালে হুলহুলিয়াতে ডিজিটাল হাব প্রতিষ্ঠিত করা হয়। ২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা ব্যয়ে তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এটি প্রতিষ্ঠা করে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার এটি উদ্বোধন করেন। এই ডিজিটাল হাব সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। এতে ১১টি কম্পিউটার, একটি প্রজেক্টর, একটি লাইভ টেলিভিশন রয়েছে। এছাড়াও একটি ডিজিটাল ইসিজি রুম রয়েছে। হুলহুলিয়া গ্রামের একটি নিজস্ব ওয়েবসাইটও রয়েছে।

নাটোর সিংড়া থানার ওসি নূরে আলম সিদ্দিক বলেন, “আমি প্রায় দুই বছর ধরে এ থানায় চাকরি করছি। এখন পর্যন্ত কোনো মামলা মোকদ্দমা করতে দেখিনি। এই গ্রামের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক ভালো।“
নাটোর সিংড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার এম এম সামিরুল ইসলাম সংবাদ প্রকাশ-কে বলেন, “আমার এই কর্মস্থলে আসা প্রায় ৭ মাস। আমি শুনেছি, হুলহুলিয়া নামে একটি আর্দশ গ্রাম রয়েছে। এ গ্রামে নিজস্ব বিচারব্যস্থা রয়েছে। কোনো ধরনের ঘটনা হলে তারাই বিচার সালিশের মাধ্যমে তা সমাধান করেন।"







































