কৃষকের পুনর্বাসন ও প্রণোদনা, ফসল উৎপাদন এবং তদারকি বাড়ায় বর্তমানে চাহিদার অতিরিক্ত খাদ্যশস্য উৎপাদনে সক্ষম হয়েছেন খুলনার কৃষকেরা। জেলার ৯ উপজেলার উৎপাদিত শাকসবজি ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করছে পাইকারি সবজি ব্যবসায়ীরা।
এই অঞ্চলের কৃষি উৎপাদনকে কেন্দ্র করে খুলনা জেলার ডুমুরিয়ায় গড়ে তোলা হয়েছে আধুনিক ভিলেজ মার্কেট। এখানকার কৃষকের উৎপাদিত বিভিন্ন কৃষিপণ্য ইউরোপসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে।
সরকার উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ত জমিতে বহুমুখী ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করায় এর সুফল পাচ্ছেন প্রান্তিক কৃষকেরা। ফলে খুলনার বিভিন্ন উপজেলায় খালে-বিলে নারী কৃষকের চালে মৎস্যঘেরের বেড়িতে শোভা পাচ্ছে লাউ, ঢেঁড়স, করলা, মিষ্টি কুমড়া, বরবটি, শিম, উচ্ছে, ঝিঙে, কুমড়া, পেঁপে, শসা, পুঁইশাক, লালশাক, ক্ষীরাসহ নানা ধরনের সবজি।
কৃষি প্রকল্পের বিভিন্ন মৌসুমভিত্তিক প্রশিক্ষণ ও বিনা মূল্যে সার ও বীজ প্রদান করে কৃষকদের প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। ফলে রবি মৌসুমে গম, আলু, মিষ্টি আলু, সরিষা, ভুট্টা, ইক্ষু, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, ধনিয়া, মসুর, মুগ, খেসারি, মটর, মাষকলাই, অড়হর, তরমুজসহ শীতকালীন শাকসবজির উৎপাদন গত বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে।
খুলনার কৃষকেরা দীর্ঘদিন খাদ্যসংকটে থাকলেও এখন নিজেরাই নিজেদের পুষ্টি ও খাদ্য তৈরি করার পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি করছেন। বিশেষত খুলনার বটিয়াঘাটা, দিঘলিয়া, রূপসা, কয়রা, পাইকগাছা ও তালা উপজেলার কৃষকরা কৃষিবিপ্লব ঘটিয়েছেন। তারা এক ফসলি জমিতে এখন বহু ফসলি জমিতে রূপান্তরিত করেছেন। ফলে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন খুলনাঞ্চলের কৃষকরা।
খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে খুলনায় রেকর্ড খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে। বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিপর্যয় কাটিয়েও খুলনার কৃষক খাদ্যশস্য উৎপাদনে উল্লেখযোগ্যভাবে সফল হয়েছেন।
দানা শস্যের পাশাপাশি শাকসবজি উৎপাদনেও রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে খুলনায়। গত পাঁচ বছরে গড়ে সাড়ে তিন লাখ টন শাকসবজি উৎপাদন হয়েছে।
গত দেড় দশকে কৃষিতে খুলনায় উন্নয়ন হয়েছে আগের তুলনায় প্রায় তিন গুণের বেশি। উপকূলীয় জেলা হওয়ায় ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা, সেচের পানির দুষ্প্রাপ্যতাসহ বিভিন্ন সমস্যা কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। ২০০৭ সালে সিডর ও ২০০৯ সালে আইলার ছোবলে উপকূলীয় এলাকায় কৃষি মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়। এরপরে আম্পান ও করোনা তার প্রভাব সামগ্রিক কৃষি খাতকে বিপর্যস্ত করে তোলে।
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, দুই যুগ আগেও উপকূলীয় এলাকায় একটি বা দুটি ফসল হতো। বছরের অধিকাংশ সময় কৃষিজমি পতিত অবস্থায় থাকত। এখন সেসব জমিতে তিন থেকে চারটি ফসল উৎপাদন হচ্ছে। আবার একই জমিতে মাল্টিলেয়ার পদ্ধতিতে একসঙ্গে একাধিক ফসলও চাষ হচ্ছে। এভাবে জমির বহুমুখী ব্যবহারে বদলে যাচ্ছে কৃষকের ভাগ্য। জানা যায়, প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘গোপালগঞ্জ, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প’-এর আওতায় সার্ভে করে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল পরিবেশ প্রতিবেশ উপযোগী গবেষণা কার্যক্রম জোরদারকরণের মাধ্যমে কৃষির উন্নয়ন প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক খুলনার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. হারুনর রশিদ বলেন, “সরকার উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষকের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জনের ওপর জোর দিয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট গোপালগঞ্জ জেলার বিএআরআইবির কৃষি গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন ও দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল পরিবেশ প্রতিবেশ উপযোগী গবেষণা কার্যক্রম জোরদারকরণের মাধ্যমে কৃষির উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থায়নে মিশ্র ফলের বাগান করতে ফলের চারা, বেড়া সরঞ্জাম, সার, কীটনাশক দিয়েছে।
হারুনর রশিদ বলেন, “আমাদের বৈজ্ঞানিকরা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করছেন এ অঞ্চলের কৃষকদের ভাগ্য উন্নয়নে। উদ্ভাবিত কার্যকরী প্রযুক্তিগুলো মাঠপর্যায়ে দ্রুত জনপ্রিয় করতে প্রকল্পের আওতায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সার্বিক সহযোগিতা উচ্চফলনশীল জাতগুলোর উপযোগিতা যাচাইয়ের পর পতিত জমি চাষাবাদের আওতায় আনা হচ্ছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপযোগী সবজি, ফল, ডাল, আলু, তৈলবীজ, গম, ভুট্টা, নারিকেল, তাল এবং খেজুরের উৎপাদন বাড়ানো ও কৃষকদের আয় বাড়ানোর পথ সহজ হবে।”