১৯৭১ সাল, আজ থেকে ৫১ বছর আগের সময়। এই সময় বা সাল ফুটবল বিশ্বে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? কারণ, ১৯৭১ সালেই শেষবারের মতো পেশাদার ফুটবলে মাঠে নেমেছিলেন ব্রাজিলের সদ্য প্রয়াত কিংবদন্তী ফুটবলার পেলে।
অর্ধশত বছর আগে একটা লোক ফুটবল থেকে অবসর নিয়েছেন, অথচ এখন পর্যন্ত সেই লোকটি থাকেন বিশ্বের ফুটবলের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। এই একটা ঘটনাতেই অবশ্য অবাক হওয়ার অত বেশি কিছু নেই।
অনেকেই দাবি করে থাকেন, আন্তর্জাতিক বা ঘরোয়া সব ফুটবলেই সত্যিকারের প্রথম সুপারস্টার পেলে। সর্বকালের সেরা বাছাই করতেও অনেকে পেলেকে আলাদা করে রাখেন আগেই। তবে ফুটবল যে শুধুমাত্র খেলা নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু এটা বোধহয় পেলের মতো আর কেউই প্রমাণ করতে পারেননি।
পেলের খেলা দেখার জন্য যুদ্ধ থেমে গিয়েছিল, এই ইতিহাস মোটামুটি ফুটবল প্রেমীদের কমবেশি সবারই জানা। এখন পর্যন্ত যুদ্ধ থামার ঘটনা বাস্তব না কি কথিত ঘটনা সেটা নিয়েও তর্ক চলে হারহামেশাই।
ঘটনা ১৯৬৯ সালের, ততদিনে ব্রাজিলকে দুইবার বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন পেলে। পুর বিশ্ব বুদ হয়ে থাকতো পেলের পায়ের যাদুতে। ব্রাজিলিয়ান ক্লাব সান্তোস তখন আফ্রিকান মহাদেশে ভ্রমণে বের হয়েছিল। পেলে তখন সান্তোসের হয়ে খেলতেন।
এক পর্যায়ে সান্তোস যখন নাইজেরিয়া পৌঁছায়, তখন সেখানে তুমুল গৃহযুদ্ধ চলছিল। নাইজেরিয়ার দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চল স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল, যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘বায়াফ্রা’। এর ফলে দেশটির দুটি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী ‘ইগাবো’ ও ‘হাউসা’ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাচ্ছিল যুদ্ধে।
এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে ১৯৬৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারী নাইজেরিয়া পৌঁছায় পেলের সান্তোস। পেলের আগমরণ উপলক্ষ্যে ওইদিন নাইজেরিয়ায় সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়।নাইজেরিয়ার বেনিন সিটিতে একটি প্রীতি ম্যাচের আয়োজন করা হয়েছিল। পেলের খেলা দেখার জন্য ইগাবো ও হাউসা রীতিমতো একদিনের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছিল।
ওই ম্যাচে পেলের সঙ্গে সান্তোসের হয়ে খেলেছিলেন এদু। পরবর্তীতে ওই ম্যাচের স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেছিলেন, “এক ব্যবসায়ী থন বলেছিল আমাদের যুদ্ধের মধ্যে কিছু দেশ খেলতে দেখতে চায়। এরপর কতৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে যুদ্ধব বিরতির ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল।”
তবে ওই পর্যন্তই! সান্তোস বিমানে ওঠার পরই আবার যুদ্ধ পুনরায় শুরু হয়েছিল। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত বায়াফ্রা–যুদ্ধ চলেছিল। এতে প্রায় ২০ লাখ সাধারণ মানুষ মারা যায়। ঘরবাড়ি ছাড়া হয় আরও ৪৫ লাখ মানুষ।
তবে সান্তোসের সেই সফরে যে যুদ্ধ থেমেছিল তা অফিশিয়ালি কখনো স্বীকৃতি পায়নি। যে কারণে এখনও অনেকেই এই ঘটনাকে প্রচলিত বা কথিত ঘটনা হিসেবে দাবি করেন।
তবে পেলে নিজে ২০২০ সালে যুদ্ধ থামানোর বিষয়ে নিজেকে গর্বিত বলে দাবি করেছিলেন। ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড পেজে পেলে লিখেছিলেন, “১৯৬৯ সালে নাইজেরিয়ায় গৃহযুদ্ধ থামানো আমার ক্যারিয়ারের অন্যতম গর্বের মুহূর্ত। সান্তোসকে সবাই এত ভালোবাসত যে ম্যাচের দিন যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়। “সান্তোস যেদিন যুদ্ধ থামিয়েছিল”—পরে এই ঘটনাটা এভাবেও বলা যায়।”
“চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়- বিচ্ছেদ নয়, চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন-করা আর্দ্র রজনী, চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে আমার না-থাকা জুড়ে” বাংলাদেশি সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক রুদ্র মুহম্ম শহিদুল্লাহ’র এই কবিতার লাইনগুলো আজ পেলের সঙ্গেই মিলে যাচ্ছে।
পেলে মারা গেছেন, শারীরিকভাবে হয়তো এই পৃথিবীতে আর নেই। তবে তিনি বিশ্বের কোটি কোটি ফুটবল ভক্তের হৃদয়ের বড় অংশ জুড়ে আগেও ছিলেন, এখনও আছেন আর ভবিষ্যত্তেও অবশ্যই থাকবেন।