মুসকান; ভারতের এক প্রতিবাদী নারী। তাকে অভিবাদন। নারীরা এভাবে জেগে ওঠুক, নিজেদের কথা বলতে পারুক। এটা ব্যক্তি স্বাধীনতা। একজন নারী সামাজিক বিধিনিষেধ ভেঙে প্রকাশ্যে তার কণ্ঠ তুলে ধরতে পারছে—এটা সুখের সংবাদ। সে যেকোনো ধর্মের হতে পারে, হিন্দু কিংবা মুসলমান অথবা অন্য যেকোনো ধর্মের। সে ধর্মীয় বিধিনিষেধ মানতে পারে, আবার নাও মানতে পারে; এটা তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত। সে কোনো কিছু আঁকড়ে ধরতে যুক্তি প্রদর্শন করতে পারে, প্রতিবাদ জানাতে পারে—এখানে বাধা দেওয়া যাবে না। এটা অধিকার তার।
এ মুহূর্তে তুমুল আলোচিত কর্নাটকের এই তরুণী। ভারতজুড়ে আলোচিত, সঙ্গে প্রতিবেশী আমরাও এ আলোচনায় অংশ নিচ্ছি। যদিও এটা আমাদের দেশের নয়, তবু এ নিয়ে ভাবছি। কারণ প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের অনেক কিছুর প্রভাব আমাদের এখানে এসে পড়ে। ঘটনার সঙ্গে যখন ধর্মের যোগ থাকে, এবং ধর্মকে নিয়ে আসা হয় তখন, প্রভাব আরও বেশি পড়ে।
তার কণ্ঠ দিয়ে উচ্চারিত ‘আল্লাহু আকবার’ শব্দদ্বয়ে আমাদের অনেকেই আবিষ্ট। এ থেকে অনেকেই ইসলামের পতাকার আগমনী বার্তা দেখছেন, স্বপ্নও দেখছেন কেউ-কেউ। অনেকের প্রেরণা জোগাচ্ছে আফগানিস্তান, কিন্তু ব্যক্তিক চিন্তা থেকে হলেও চাইলে আফগানিস্তানের পরিণতি কোথাও সম্ভব? ভারতে তো নয়ই। এমনকি আফগানিস্তানেও বর্তমান আফগানিস্তান পরিস্থিতি সুস্থ চিন্তকেরা চাইবে না। সুখের খবর, আলোচিত তরুণী তালেবান নন, তালেবানি ভাবধারার নন বলেও বিশ্বাস করতে চাই। তালেবানি হলে নিশ্চয়ই তার উচ্চশিক্ষার আগ্রহ থাকত না, স্কুটি চালিয়ে কলেজ পর্যন্ত যাওয়া হতো না তার!
তবে তার যা চাওয়া তার পুরোটাই নিজস্ব আচার ও বিশ্বাসকেন্দ্রিক। ধারণা করা যায়, তিনি ধার্মিক, ইসলাম ধর্মাবলম্বী। ধার্মিক হতে পারেন, আবার নাও হতে পারে। ধর্মমতে তিনি বোরখা পরতে পারেন, হিজাব পরতে পারেন; আবার কেবল পোশাক-রুচি অনুযায়ী ওসব তিনি পরতে পারেন। তিনি জানাচ্ছেন, এতদিন সমস্যা হচ্ছিল না তার। তবে সাম্প্রতিক কর্নাটক পরিস্থিতি তাকে অন্য বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তিনি হয়তো গোড়া ধার্মিক পর্যায়ের নন। তাই কলেজের নিয়ম মেনে ক্লাসে বোরখা রেখে কেবল হিজাব পরেই বসেন। সেদিন অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে কলেজে গিয়েছিলেন। কলেজে ঢুকতে যাওয়া মুহূর্তে একদল গেরুয়া উত্তরীয় পরা লোক তাকে তাড়া করে। তাকে উদ্দেশ করে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দেয়। একটা তরুণীকে কয়েকশ’ তরুণ উত্যক্ত করছে, ধর্মীয় স্লোগান দিচ্ছে; তার কি উচিত ছিল মুখ বুজে সহ্য করার? কিছু না বলে ফিরে আসার? না, মুসকান সেটা করেননি। উত্যক্তকারীদের বিপক্ষে একাই লড়েছেন। প্রত্যুত্তরে দিয়েছেন ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি। উত্যক্ত করতে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনির প্রতিবাদে আর কী ধ্বনি দিতে পারতেন তিনি? স্রেফ একটা পোশাককে নিয়ে যখন এত কিছু, এই পোশাকের বিপক্ষে যখন ধর্মের আশ্রয়, তখন প্রতিবাদে অনুরূপ হওয়া কি অস্বাভাবিক কিছু?
মুসকানের বরাত দিয়ে এনডিটিভি জানাচ্ছে, ‘ওই যুবকদের বেশির ভাগ বহিরাগত। তারা কলেজের শান্তি নষ্ট করার চেষ্টা করছে। হিজাব নিয়ে কলেজের হিন্দু বন্ধুরা কিছু না বললেও বহিরাগত যুবকরা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে।’ ওই সময়কার বর্ণনা দিয়ে মুসকান বলেন, ‘আমি ভয় পাইনি। কলেজে ঢোকার সময় আমি বোরখা পরা দেখে তারা আমাকে ঢুকতে দিতে চাইছিল না। তারা ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিতে থাকলে আমি ‘আল্লাহু আকবার’ বলতে শুরু করি। কলেজের অধ্যক্ষ ও প্রভাষকেরা আমাকে সমর্থন দিয়েছেন এবং আমাকে সুরক্ষা দিয়েছেন।’ মেয়েটির আক্ষেপ—‘আমাদের কাছে শিক্ষার প্রাধান্য সবার আগে। এক টুকরো কাপড়ের জন্য ওরা আমাদের পড়াশোনা করার অধিকারটাই ছিনিয়ে নিতে চায়!’
হ্যাঁ, এই ‘এক টুকরো কাপড়’ এখন কর্নাটকের অনেকের শিক্ষা-অধিকারের পথে বাঁধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। নারীশিক্ষা, নাকি এক টুকরো কাপড়—কোনটা মুখ্য? নীতিনির্ধারকেরা চাইলে সরকারি ফরমানে এক টুকরো কাপড় বর্জনকে নারীশিক্ষার জন্যে অত্যাবশীয় যোগ্যতা চাপিয়ে দিতে পারেন, আবার চাইলে পারেন নারীর ইচ্ছা-স্বাধীনতাকে মূল্যায়ন করতে। এখানে অনেকেই বলতে পারেন দেশে-দেশে হিজাব-বোরখা নিষিদ্ধ হচ্ছে, ভারতের ওই এলাকায় নিষিদ্ধ হলে সমস্যা কী? সমস্যা থাকত না যদি ওই অঞ্চলে স্রেফ ধর্মের ভিত্তিতে অনেক কিছু না ঘটত। সমস্যা ছিল না যদি সেই অঞ্চলে ধর্মীয় বিভক্ত, হানাহানি, সহিংসতার উপস্থিতি না থাকত। সমস্যা, কারণ ভারতের শাসকগোষ্ঠী বিজেপির বিরুদ্ধে তীব্র সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ! উদার গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের সাম্প্রতিক বিভাজন যেখানে প্রধানত ধর্মকেন্দ্রিক, সেখানে এই মুহূর্তে পশ্চিমা অনেক দেশের মতো অনেক কিছু এখানে যৌক্তিকতার মানদণ্ডে টেকে না। এজন্যে দেশটিকে অপেক্ষা করতে হবে আরও, যতদিন না দেশটির নীতিনির্ধারকেরা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি না বদলান!
মুসকান কেন বোরখা পরে কলেজে যাবে—এ যুক্তি অনেকের। কিন্তু এই যুক্তি টেকে না যতক্ষণ না সেটা কলেজ কর্তৃপক্ষের হয়। কলেজ কর্তৃপক্ষ তার পোশাক নিয়ে আপত্তি যেখানে করছে না, সেখানে বহিরাগতরা কেন তাকে বাধা দেবে? সেই বহিরাগতদের বিরোধিতার মুখে মুসকান পড়েছিলেন তার পোশাকের কারণে, কিন্তু বাধা দিতে এসে তারা যে ধ্বনি দিয়েছে, সেটা কি ধর্মীয় নয়? তাদের দৃষ্টির ‘ধর্মীয় পোশাকের’ আপত্তি জানাতে তারা যদি ধর্মনিরপেক্ষতার পরিচয় দিতো, তবে এত আলোচনার দরকার ছিল না। গোঁড়ামি দিয়ে কি সবকিছু সম্ভব?
মেয়েটির ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনিতে প্রতিবাদ তাই ধর্মীয় প্রতিবাদ নয়, এটা এক সাহসিকার স্মারক হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিবাদের ব্যাকরণ নেই, প্রতিবাদের নিজস্ব ভাষার নাম ‘প্রতিবাদই’, তা যে প্রক্রিয়াতেই হোক না কেন!
মুসকান কেবল ভারতেই আলোচিত নন, তিনি সমভাবে বাংলাদেশেও আলোচিত একজন। তাকে নিয়ে অনেকেই নানাভাবে বিশ্লেষণ করছেন। একদল পক্ষ নিচ্ছেন নারীর প্রতিবাদী অবস্থান দেখে, একদল পক্ষ নিচ্ছেন মুসকানের মুখে ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনিতে ধর্মের বিজয় দেখে। অথচ এটা কোনোভাবেই ধর্মীয় বিজয় নয়, এটা সাম্প্রদায়িক লোকজনের উত্যক্তের বিরুদ্ধে এক মজলুমের প্রতিবাদ।
ওখানে যারা মুসকানের প্রতিবাদে ‘প্রতিবাদ’ না দেখে কেবল ধর্ম দেখছেন, তাদের অনেকেই হয়তো হেফাজতে ইসলামের প্রয়াত নেতা শাহ আহমেদ শফীর ভাবানুসারী। যিনি একবার এক ওয়াজে বলেছিলেন, “আপনাদের মেয়েদের স্কুল-কলেজে দেবেন না। ক্লাস ফোর বা ফাইভ পর্যন্ত পড়াতে পারবেন। এর বেশি যদি পড়ান, পত্রপত্রিকায় দেখছেন আপনারা? মেয়েকে ক্লাস এইট, নাইন, টেন, এমএ, বিএ পর্যন্ত পড়ালে ওই মেয়ে কিছুদিন পর আপনার মেয়ে থাকবে না। তাই আপনারা আমার সঙ্গে ওয়াদা করুন। বেশি পড়ালে আপনার মেয়েকে টানাটানি করে অন্য পুরুষ নিয়ে যাবে। এ ওয়াজটা মনে রাখবেন।” আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম বা হাটহাজারি মাদ্রাসার এক ওয়াজ মাহফিলে ২০১৯ সালে এমনটা বলেছিলেন প্রয়াত মাওলানা শফী। কর্নাটকের আলোচিত মুসকান কিন্তু ওই ক্লাস ফোর বা ফাইভ অতিক্রম করেছে আগেই, এখন সে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। সে স্কুটি চালিয়ে কলেজে যাওয়া এক তরুণী। সুতরাং শফীদের দৃষ্টিতে সে আগে থেকেই বিপথগামী! তাকে নিয়ে তাই এ শ্রেণির উচ্চাকাঙ্ক্ষার সুযোগ নেই।
আমাদের এখানে আরেক দলের আবির্ভাব হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যাদের ভাষ্য মেয়েটি কেন ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনিতে প্রতিবাদ করল? কেন? ওই পরিস্থিতিতে আর কীভাবে প্রতিবাদ সম্ভব? প্রতিবাদের নিজস্ব কোনো ব্যাকরণ আছে কি? গেরুয়া উত্তরীয় পরিহিত একদল লোক ‘জয় শ্রীরাম’ বলে একটা তরুণীকে উত্যক্ত করছে এবং তাদের লক্ষ্যই যেখানে ধর্মীয় বিভাজন, সেখানে এরচেয়ে প্রাসঙ্গিক আর কি কোনো স্লোগান তাৎক্ষণিক আসা সম্ভব?
প্রতিবাদের ভাষা যাই হোক, আমাদের কাছে মেয়েটির দৃঢ়তা উল্লেখের মতোই। এখানে আমি তাই তার প্রতিবাদকে ধর্মীয় বিভাজনে রাজি নই। এখন পর্যন্ত তাকে এক সংগ্রামী নারী হিসেবেই দেখছি! সে বাড়িতে কী পরে, বাইরে যেতে কী পরে, কলেজে যেতে কী পরে, কেন পরে—ওসব মুখ্য নয়; মুখ্য তার প্রতিবাদ। মেয়েটি একা লড়েছিল, এটা অনেক বড় কিছু!
পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের একটা মেয়ে যদি প্রতিবাদ করতে জানে, তার প্রতিবাদ আমাদের আমলে নেওয়া উচিত। সে তার কণ্ঠকে রুদ্ধ না করে উচ্চকিত হতে জানে—এটাই তো পাওয়া আমাদের। কর্নাটকের মুসকান অন্তঃপুরবাসিনী নয়, সে লেখাপড়ার জন্যে বাইরে বেরুতে জানে, সে লেখাপড়ার অধিকারের জন্যে লড়তে জানে, সে বলতে জানে—এক টুকরো কাপড়ের জন্যে কেন ধ্বংস হবে শিক্ষার অধিকার।
ওখানে মুসকান জয়ী হোক, মুসকানরা প্রতিবাদ করতে শিখুক; এখানে ‘পূর্ণিমারা’ও জয়ী হোক, প্রতিবাদ করতে শিখুক।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক