• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আত্মহত্যা রোধে চাই সামাজিক আন্দোলন


জান্নাতুল যূথী
প্রকাশিত: মার্চ ২৯, ২০২২, ০৮:৪৩ এএম
আত্মহত্যা রোধে চাই সামাজিক আন্দোলন

সম্প্রতি টেলিভিশন চ্যানেল, দৈনিক পত্রিকা বা অনলাইন পোর্টালে তাকাতেই একটি বিষয়ে গিয়ে চোখ আটকে যায়, ‘আত্মহত্যা’। বর্তমান যুগে ‘আত্মহত্যা’ এমন একটি সামাজিক ব্যাধি, যা নিয়ে চুপ থাকলে জাতির জন্য দুর্দিন সুনিশ্চিত। একটি দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ তার জনগণ। সেই মানবসম্পদ যখন হুমকিতে পড়ে, তখন সবারই সতর্ক হওয়া উচিত। কিন্তু কেন এই আত্মহত্যা? কেন জীবনকে এত তুচ্ছ মনে হওয়া? সব ধরনের অভিমত একপাশে রেখে একটু নিরপেক্ষভাবে ভেবে দেখার সময় হয়তো এসে গেছে। কেন ঘটছে আত্মহত্যা। সত্যি কি এর কোনোই সমাধান নেই। এটি কি শুধুই সামাজিক অবক্ষয়! দুর্ভাগ্যের বিষয় হলেও সত্য প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় নানা কারণে আত্মহত্যার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেই চলেছে। এভাবে দিনে দিনে আত্মহত্যার পরিমাণ বাড়তে থাকলে সমাজে বাড়তে থাকবে অস্থিরতা। 

আমাদের দেখতে হবে, কেন আত্মহত্যা বেড়েই চলেছে। এই বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গেলে, প্রথমেই আসবে মানসিক চাপের কথা। একজন ব্যক্তি বিভিন্ন কারণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হতে পারেন। পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক নানাবিধ কারণেই সেটা ঘটতেই পারে। মানসিক চাপ যতটা না পারিবারিক, সামাজিক তার চেয়েও বেশি আকাঙ্ক্ষার! কিছু  উদাহরণ দেওয়া যাক। 

কিছুদিন আগের ঘটনার জের টেনেই বলি, ইন্ডিয়ান সিরিয়াল দেখে অনেক নারীর ‘পাখি ড্রেস’-এর প্রতি প্রবল আবেগ ও আকাঙ্ক্ষার জন্ম হয়! অনেকেই আবেগ ধারণ না করতে পেরে আত্মহত্যার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটিয়েছে! এখন কথা হচ্ছে এই ড্রেস কত বছর টিকবে? সর্বোচ্চ ১ বছর বা তার কিছু বেশি। কিন্তু যে ব্যক্তিটি নিজের হাতে জীবনকে বিসর্জন দিলেন, তার জীবন কি ওই ১টি বছরেই সীমাবদ্ধ? আমি হলফ করে বলতে পারি কখনোই না। তাহলে মাত্র ১টি বছরকে ঘিরে জীবনাবসান ঘটানো কেন? করোনাকালে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকাকে কেন্দ্র করে ইন্টারনেটে ক্লাস চলেছে। সেখানেও দেখা যায় একই পরিণতি। অনেকেই অ্যান্ড্রয়েড ফোন না পেয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। কিছুদিন আগে ময়মনসিংহের একটি ঘটনা দেখে রীতিমতো খুবই কষ্ট পেলাম। একটি ফুটন্ত কুড়ি ফোটার আগেই ঝরে গেল। বাবা-মায়ের সঙ্গে অভিমান করে নিজের মৃত্যু ঘটাল। এছাড়া পদোন্নতি, পরীক্ষায় সন্তোষজনক ফল না করার কারণ তো আছেই। কিন্তু বিষয়টা কি সমাধানযোগ্য নয়? প্রত্যাশা-প্রাপ্তির প্রতি যদি নিয়ন্ত্রণ থাকে তাহলে এই ধরনের ঘটনাকে অনেকটা কমিয়ে আনা যাবে।

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ যে বিষয়টা মানুষকে আত্মহত্যাকেন্দ্রিক করে তুলছে, সেটা ‘বেকারত্ব’। আমরা জানি, বেকারত্বকে মানবজীবনের অভিশাপস্বরূপ মনে করা হয়। এই প্রসঙ্গেও কিছু কথা না বললেই নয়। এই বেকারত্ব ঘোচানো কি মানুষের দ্বারা কোনো দিনই সম্ভব নয়? অবশ্যই সম্ভব। সময়মতো প্রত্যাশার লাগাম টানতে পারলে অবশ্যই সম্ভব। বেকারত্ব ঘুচবে কিন্তু প্রত্যাশা না-ও পূরণ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে একটি বিষয়কে তুলে ধরতে চাই, ‘বেকারত্ব’ যার প্রতি রুষ্ট হয়ে নিজের জীবনকে শেষ করছি, সেই বেকারত্ব তো ঘোচানো সম্ভব। কিন্তু যে ব্যক্তির ২টি চোখই নেই, যার পা নেই বা যার সবই ছিল; কোনো এক দুর্ঘটনায় সব হারিয়ে নিঃস্ব। সেই ব্যক্তির পক্ষে কি কোটি টাকা শেষ করেও চোখকে ঠিক করা সম্ভব? হয়তো সম্ভব নয়। পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটাই আসল। জীবনকে প্রতিমুহূর্তে যাপন করতে হবে। একটি সুদীর্ঘ জীবনে ভুলচুক থাকবে না এটা কীভাবে সম্ভব? জীবন তো আর কল্পকাহিনির সাজানো চরিত্র নয়। 

সম্পর্কছেদকে কেন্দ্র করেও ঘটছে আত্মহনন। কখনো সেটা প্রেমের বা বিয়ের। কিন্তু একটিবার যদি গভীরভাবে ভাবা যায় তাহলে প্রত্যেকেই হয়তো স্বীকার করবেন যে, এখান থেকেও চেষ্টা করলে বের হওয়া যায়। যৌন-নিপীড়নের কারণে অনেকেই আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। কর্মক্ষেত্রে, যানবাহনে, ইন্টারনেটে বিভিন্ন মাধ্যমে নারী-পুরুষ যৌন-নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এসব ঘটনার প্রতি সমাজ সংবেদনশীল হলে এখান থেকেও পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। এছাড়া মানবিক দিক বিবেচনায় আইনি সহয়তার চর্চা করতে হবে।

ব্যক্তির কাজের অবমূল্যায়ন তাকে অনেক সময় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে। চাকরিরত প্রতিষ্ঠান, সহকর্মী দ্বারা বিভিন্নভাবে হেনস্তার ঘটনা ব্যক্তিকে মানসিকভাবে দুর্বল করে তোলে। এসব চাপ সামলাতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নেয় অনেকেই। পারিবারিক সহিসংসতা মানুষকে আত্মহত্যাপ্রবণ করে তোলার পেছনে একটি বড় কারণ। সন্তান যখন পারিবারিক অশান্তি নিয়ে বড় হয়, তখন তার মনে ব্যাপক প্রভাব পড়ে। তাই সন্তানের বেড়ে ওঠার সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে তোলাও পরিবারের দায়িত্ব। অর্থনৈতিক বৈষম্য মানুষকে রূঢ় করে তুলছে প্রতিনিয়ত। যুগের সঙ্গে অনেকেই খাপ খাওয়াতে না পেরে মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে পড়ছে।

এ তো গেল আত্মহত্যার কারণ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা। মানুষকে এই মানববিধ্বংসী হীনকর্ম থেকে ফিরিয়ে আনতে হলে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে—শিশুর বর্ধন ও বিকাশকাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। শিশুকে এ সময় মানবিক শিক্ষা, ভালো-মন্দের জ্ঞান দান, যেকোনো পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার শিক্ষা ধারণা দিতে হবে। প্রবাদ আছে, কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ পাকলে করে ঠাস ঠাস! শৈশবেই পরিস্থিতি মোকাবিলার সক্ষমতা গড়ে তুললে কৈশোর থেকে পরিণত বয়সে  কোনো মানবসন্তানের আর জীবনবিমুখ হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না।

পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুকে জীবনের মূল্য সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে, জীবনসংগ্রামে সাফল্য-ব্যর্থতার যেকোনো একটি আসতেই পারে। কোনো একটি ব্যর্থতার জন্য পুরো জীবনকে অসার ভাবার কোনো কারণ নেই। বরং প্রতিটি ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সাফল্যর প্রস্তুতি নিতে হবে। ব্যর্থতা মানেই শেষ হয়ে যাওয়া নয়, বরং  প্রতিটি ব্যর্থতা হলো সাফল্য অর্জনের পথে একধাপ এগিয়ে যাওয়া।

জীবনের মমত্ববোধ জাগানোর প্রধান শর্ত হলো পারিবারিক বন্ধন। যে পরিবারের বন্ধন যত দৃঢ়, সে পরিবারের সদস্যদের পরস্পরের প্রতি মমত্ব, দায়িত্ববোধও তত বেশি। ফলে তুচ্ছ কারণে মায়ার বন্ধনকে অস্বীকার করে কেউ নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে তুলতে চাইবে না। তাই সমাজ-রাষ্ট্রের উচিত পারিবারিক বন্ধনকে দৃঢ় করে তোলার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা। পরিবার শিশুর প্রথম ও প্রধান শিক্ষালয়। তাই এখান থেকেই জীবনের মৌলিক পাঠগ্রহণ করতে হবে। এখান থেকেই শিশুকে জীবনমুখী করে গড়ে তুলতে হবে। বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠলে হতাশা-বিষণ্নতা-একাকিত্বের মতো ভয়াল পরিস্থিতি মানবমনে ঠাঁই পাবে না।

মানুষকে আনন্দের সঙ্গে বসবাস করার নিশ্চয়তা দিতে হবে। তাকে স্বপ্নবান করে তুলতে হবে। আনন্দের সঙ্গে বসবাসের প্রধান শর্ত পছন্দ অনুযায়ী সঙ্গী নির্বাচন। সঙ্গী নির্বাচনে ভুল হলে জীবন যন্ত্রণাময় হয়ে ওঠে। তাই পছন্দ অনুযায়ী সঙ্গী নির্বাচন ও সঙ্গীর সঙ্গে সমঝোতাপূর্ণ বসবাস সম্ভব হলে, জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা জাগবে না।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মানুষের দুর্বলতা শনাক্ত করে তা নিয়ে বিদ্রূপ করা। অনেকেই মানুষের ব্যক্তিগত স্পর্শকাতর বিষয় জেনে নিয়ে সেই বিষয়ে নানা উছিলায় তাকে খোঁচা দেয়। এতে ব্যক্তি বিব্রত হতে থাকে। একসময় বেঁচে থাকার আগ্রহও হারিয়ে ফেলে। তাই কাউকে তার দুর্বল দিক নিয়ে কটাক্ষ করা থেকে মানুষকে বিরত রাখার চেষ্টা করতে হবে। এই দায়িত্ব সমাজ ও রাষ্ট্রের।  

নিজেকে আনন্দজনক কর্মে ব্যস্ত রাখার একটি উপায় হলো, বইপড়া। মানুষের মধ্যে বইপড়ার সংস্কৃতির চর্চা বাড়াতে হবে। এই লক্ষ্যে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। মানুষ যখন বইয়ের ভেতর ডুব দেবে, জীবন তাকে হতাশ হওয়ার কোনো সুযোগ দেবে না। সে তখন ব্যস্ত হয়ে পড়বে জীবনের নানা দিকের আনন্দ লাভের দিকে।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না—বর্তমান যুগে ইন্টারনেটশাসিত যুগ। এই যুগে বেঁচে থাকার উপায় নিয়ে যেন শত শত কন্টেন্ট ইন্টারনেটে ভেসে বেড়ায়, তেমনি আত্মহত্যার যৌক্তিকতা নিয়ে রচিত কনটেন্টও রয়েছে সেখানে। এই ক্ষেত্রে নেতিবাচক কনটেন্টগুলো সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। নেচিতবাচক কনটেন্ট দেখা মাত্রই সেগুলো সরিয়ে ফেলার উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে।

এরপরও কোনো কারণে কারও আচরণে জীবনবিমুখ হয়ে পড়ার লক্ষণ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে হবে। কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে যে কাউকে জীবনের প্রতি আকৃষ্ট করা সম্ভব। তাকে বোঝাতে হবে—আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়, জীবনকে ভালোবাসতে হবে। প্রয়োজনে এই লক্ষ্যে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এরই অংশ হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়ায় আত্মহত্যাবিরোধী কনটেন্ট প্রচারের পাশাপাশি বিভিন্ন সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। অন্য কোনো পদক্ষেপও যদি কোনো কারণে সফলতার মুখ না দেখে, সমস্যা নেই। কেবল সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমেই মানুষকে জীবনমুখী করে তোলা সম্ভব।

একসময় কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করেও যে বাল্যবিবাহ কিংবা অ্যাসিড নিক্ষেপ পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। অথচ গণমাধ্যম-সভা-সেমিনার-হাটবাজারে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমেই মাত্র এক দশক আগে অ্যাসিড নিক্ষেপ বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। সাক্ষরতার হার বেড়েছে, জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়েছে। এমনকি যৌতুক ও বাল্যবিয়ের পরিমাণও কমে এসেছে—এই কথা বললে অত্যুক্তি হবে না। অতএব, উল্লিখিত দৃষ্টান্তগুলো অনুসরণ করে আত্মহত্যাবিরোধী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমেই এই মানববিধ্বংসী ব্যাধি পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় করা সম্ভব। সামাজিক আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন—শিক্ষক-চিকিৎসক-সাংবাদিক-জনপ্রতিনিধিরা। তাই আসুন, ব্যক্তিগত-সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়—সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আত্মহত্যাবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলি। তাহলে একদিন এই মরণব্যাধি কারও প্রাণ কেড়ে নিতে পারবে না।

লেখক: গবেষক ও শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়

Link copied!