আমি সেই একজন। হাবাগোবা নির্বোধ বেচারী মানুষ। বারবার হেরে যাই। বারবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াই। সমস্যার মুখোমুখি হই। মিউমিউ করে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করি। আবার মিনমিন করে মাথা নুইয়ে লজ্জার কথা ভাবতে ভাবতে গা ভাসিয়ে চলতে থাকি। কোনো আগডুম বাগডুম করবো না আজ। সরাসরি কথায় আসি। খুব সম্প্রতি বাসা বদলেছি। একটু নিরিবিলি সবুজের মধ্যে থাকবো বলে শহর ছেড়ে একটু দূরে। ছেলে ঢাকা শহরের মধ্যে একটি ভালো স্কুলে পড়াশোনা করে। ভেবেছিলাম, কষ্ট করে হলেও দূর থেকেই আনা-নেওয়া করা যাবে। অবশেষে হলো না। মনে করলাম, আর মাত্র দুটো মাস আছে। তারপর তো নতুন ক্লাস। আশপাশের কোনো ভালো স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিই। এদিককার স্কুলগুলো খুব সম্প্রতি তৈরি করা হয়েছে। আমাদের মতো অনেক মানুষ তাদের সন্তানদের সেখানে ভর্তির জন্যও আসছেন-যাচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, যেহেতু স্কুলগুলো এখনো ঢাকা শহরের আর পাঁচটা হৈহৈ রৈরৈ ফেলে দেয়া স্কুলের মতো হয়ে ওঠেনি, ছাত্র সংখ্যাও কম, তাই বছরের শেষে এসেও কিছুসংখ্যাক বাচ্চাকে তারা ভর্তির সুযোগ দেবে। ধন্য ধন্য করে ছুটলাম।
একদিন স্কুলটি দেখতে গেলাম। বাহ্! মন জুড়িয়ে গেল। বিশাল বড় মাঠ। স্বস্তিবোধ হলো। বাচ্চা আমার মাঠে খেলতে পারবে। বাচ্চার পুরোনো স্কুলের প্রতি প্রচণ্ড মমতা থাকা স্বত্ত্বেও তারও চোখে মাঠে খেলার নেশা ধরে গেল। দ্বিতীয় দিন গিয়ে খোঁজ-খবর করে ভর্তি ফর্ম নিয়ে এলাম। ক্লাশ ওয়ান। এ আবার এমন কী? ভর্তির সময় হয়তো বড়জোড় নাম, বাবার নাম, মায়ের নাম আর দু’ চারটা শব্দ, বানান আর ছোটখাটো যোগ-বিয়োগ।! এ কথাও জানান দিয়ে এলাম যে, আমার সন্তান এখন যে স্কুলে পড়াশোনা করে সেখানে ওদের তথাকথিত পরীক্ষার নিয়ম নেই। বছর গেলে সুন্দর টপাটপ নতুন শ্রেণিতে উঠে যায় ওরা। তবু কিছু জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবে নিশ্চই। তৃতীয় দিন যথাসময়ে ভর্তির প্রস্তুতিসহ ছেলে নিয়ে রওয়ানা হলাম। মুখ ফসকে ছেলের সামনে ‘পরীক্ষা’ শব্দটি বেড়িয়ে গিয়েছিল। তাতেই ছেলের আমার চাঁদপানা মুখ আমসত্ব হয়ে গেল। বহু রকমভাবে ‘পরীক্ষা’ নামক শব্দটিকে একটি সহজপাচ্য রূপ দিয়ে স্কুলে পৌঁছলাম। অসম্ভব ভালো লেগে গেল একাউন্ট সুপার মানুষটিকে। বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনিও ওকে নানা রকমভাবে সহজ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। একসময় একটি সাদা কাগজে কিছু লিখে বাচ্চার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, দেখি তো বাবা এগুলোর মধ্যে তুমি কোনগুলো পারো? আমার ছেলে কাগজ আর পেন্সিল নিয়ে লিখতে বসে গেল। জীবনের প্রথম পরীক্ষা। একটুখানি ধরিয়ে দিতেই সবগুলো কাজ সে একাই শেষ করলো। অঙ্কে ও একটু বেশিই ভালো। তাই ঝটপট ওটাও শেষ করলো। কিন্তু তখন ও আমার কোলে। কেন? কারণ ওটা পরীক্ষা ছিল না। আগেই বলেছি, একাউন্ট সুপার ওকে নানা রকমভাবে সহজ করার চেষ্টা করছিলেন।
এরপর কিছুটা সময় পার হলো। বিভিন্ন শ্রেণির জন্য বেশ কিছু ছেলে-মেয়ে পরীক্ষা দিতে এসেছে। ক্লাশ ওয়ানের জন্য দু’জন। একজন টিচার এসে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে দোতলায় চলে গেলেন। ভাবলাম, ৫/১০ মিনিটের মধ্যেই তো ছেলে নিচে নামবে। তা প্রায় আধা ঘণ্টা বা চল্লিশ মিনিট পর বাচ্চারা নিচে নেমে এলো। আমার এদিকে ভীষণ তাড়া। আমি শিক্ষক এবং একাউন্ট সুপারকে গিয়ে আমার কাজের গুরুত্বের কথা বলতেই উনারা বললেন, ঠিক আছে আপনি আগে আসেন। আমার বাচ্চাকে ইঙ্গিত করে বললেন, ওহ! আপনি এই বাচ্চার মা। ওতো কোয়ালিফাই করেনি। ভর্তি করলে ওকে ক্লাস ওয়ানে আরো এক বছর থাকতে হবে। আমার মাথাটা আক্ষরিক অর্থেই বনবন করে ঘুরে উঠল। এর মানে কী? অসংখ্য প্রশ্ন আর অসংখ্য বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কেন? কী দেখে আপনারা এমন সিদ্ধান্ত নিলেন? ক্লাস ওয়ানে দুই বছর রেখে বাচ্চাকে মহারথী বানাবো, এমন স্বপ্ন কস্মিনকালেও ভাবিনি। আমি হাসি মুখে বললাম, আপনাদের স্কুলে ওয়ানে পড়তে যদি দু’বছর রাখতে হয় তাহলে তো আমি এই স্কুলে ভর্তিই করবো না। তবে আমার জানা দরকার যে, আপনারা কি এমন প্রশ্ন করলেন যার মধ্যে থেকে ও কিছুই পারলো না? আর একটাও যদি না পারে তাতেই-বা কি! একটি ছয় বছরের শিশুকে ঠিক এইভাবে মূল্যয়ন করা যায় কি? নাকি করা উচিত? শিক্ষক একটু বিরক্ত। কারণ অভিভাবকদের এমন বেয়াদবি উনারা সহ্য করতে পারেন না। আর আমি সেইরকমই একজন গোবেচারা, কিন্তু একটু ঐ কিছিমেরই অভিভাবক। শিক্ষক বললেন, আপনার বাচ্চা আপনি ভর্তি করবেন নাকি করবেন না আপনার ইচ্ছে। কিন্তু আমরা ওকে সুযোগ দিতে পারবো না। একাউন্ট সুপার কিছুটা বিব্রত। বারবার বুঝাতে লাগলেন শিক্ষককে, ম্যাডাম বাচ্চাটাতো একটু আগেই আমার সামনে বসে সব লিখলো। ও যেহেতু অন্য ধরনের একটা সিস্টেম থেকে এসেছে, তাই একটু ধরিয়ে দিতে হয়। শিক্ষক বললেন, এই বাচ্চা পারবে না। কারণ ক্লাশ ওয়ানের বাচ্চারা অনেক বেশি জানে। অনেক বেশি তাদের লেখাপড়া। সিলেবাসই কাভার করতে পারবে না ও।
বিশ্বাস করুন পাঠক, ততক্ষণে আমার মাথা তো দাউ দাউ করে জ্বলছেই। মনে হচ্ছিল, দাউ দাউ করে কেন জ্বলে উঠছে না স্কুল ঘর? দাউ দাউ করে কেন পুড়ে যাচ্ছে না গলে যাওয়া পচে যাওয়া বই-খাতা-পেন্সিল। কেন পুড়ে যাচ্ছে না ক্লাশ ওয়ানের মহান সিলেবাস! আমি প্রায় চিৎকার করে শিক্ষককে থামিয়ে দিয়ে বললাম, আপনি চুপ করুন, আমার সন্তানকে আমি কোনোরকম না-বোধক শব্দ শেখাতে চাই না। আমার বাচ্চা কিছু পারে না, প্রমাণ করার জন্য পরীক্ষার খাতা মানে কাগজটি আমার সামনে তুলে ধরা হলো। আম বানান ঠিক আছে। ছাগল বানানে ও-কার, খায় বানানে ‘আ-কার’ নেই। D তে Doll বানানে একটি L নেই, A-তে Apple বানাতে E নেই। অংকের জায়গায় যোগ-বিয়োগ সমহিমায় ঝলঝল করছে। আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। একটি ভিন্ন পরিবেশে এই ছোট্ট শিশুরা ভর্তি হতে গিয়ে মায়ের কোল ছেড়ে পরীক্ষা দিতে বসেছে। তারা ভুল করবে না তো কারা ভুল করবে? একটি ছয় বছরের শিশুর জন্য এটা কি কোনো ভুল! নাকি শিশুর আত্মভোলা মন অন্যমনস্কতার ফলাফল? ভাষা হারিয়ে ফেলার পরও কোনো মতে বললাম, আমার ছেলে পারবে। আপনাদের সিলেবাসে যা আছে, তাই পারবে। তবে আমি এখানে পড়াবো কিনা সেটাই ভাববার বিষয়। শিক্ষক ততক্ষণে বলে বসলেন, একটা শর্তেই ওকে আমি ভর্তি করতে পারি। নভেম্বরে ওদের ফাইনাল পরীক্ষা। ওকে ৫০% মার্কস পেতে হবে। তাহলেই ও ক্লাস টুতে উঠার সুযোগ পাবে। শর্ত! হায় ঈশ্বর! আমার ছেলেকে শূলে চড়াবো? কাল তার বিসিএস পরীক্ষা? এবার সত্যিই আর পেরে উঠলাম না। যে শিক্ষকের শিশুর মনস্তত্ব নিয়ে পড়াশোনা নেই, সে দেবে শিশুপাঠ। মুখস্থবিদ্যা তৈরি করে দেয়া কল?
মনে হয়েছিল, শিক্ষককে প্রশ্ন করি, এখন পর্যন্ত কত প্রজাতির ডাইনোসর আবিষ্কার হয়েছে, আপনি জানেন কি? গড়গড় করে ডাইনোসরের নাম নির্ভুলভাবে বলতে পারবেন কি? কোন ডাইনোসর কত মাত্রায় বল প্রয়োগ করে কামড় বসাতো সেই তথ্য আপনার জানা আছে কি? কোন ডাইনোসর কত ইঞ্চি দাঁত, কত ফুট লেজ কত ফুট লম্বা জানেন কি? পৃথিবীর কোথায় কোন সাপ পাওয়া যায়? বাংলাদেশে কত রকম পাখির বসবাস ছিল, এখন কত রকম বাস করে জানেন কি? কোন পাখি দেখতে কেমন? পৃথিবীর মানচিত্রে কোন দেশের অবস্থান কোথায় আপনি জানেন? আকাশে বিমান দেখে পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা এবং অংকের মিশেলে ও প্রশ্ন করতে জানে এবং উত্তরও খুঁজে বেড়ায়। আপনার কি এমন একটি মন আছে? আপনি কি জানেন জাতিস্মরের অর্থ কি? যদি জানেনই তার উত্তর কি আপনি আপনার ৬ বছর বয়সসীমার মধ্যেই পেয়েছিলেন? আমার ছেলে কিন্তু জাতিস্মরের পদচিহ্ন খুঁজে বেড়ায়।
প্রিয় শিক্ষক, আপনার দুর্ভাগ্য, আপনি এমন শিশু বা শিশুদের শিক্ষক হওয়া থেকে নিজেকে বঞ্চিত করছেন। আমি গর্ব করে বলতে চাই, আমার ছেলে কিন্তু এই সবই খুব ভালোভাবে জানে। ও শুধু টিভি দেখে নয়, ওর অনেক বই আছে। যেগুলো ও নিজে পছন্দ করে কিনে। ওকে পড়ে শোনাতে হয়। শুনতে শুনতে ওর মুখস্থ হয়ে যায়। ছবি দেখতে দেখতে ও মনে রাখে। সঙ্গে আছে প্রকৃতিপাঠ। আপনাদের দুভার্গ্য আপনারা শিশুদের মনস্তত্ব বোঝেন না। মনস্তত্বপাঠ না করেই শিশুদের পাঠ দানে উদ্যেগী হোন। (দায়িত্বশীল শিক্ষদের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা রেখে) এবং শিশুদের ভুল রাস্তায় পরিচালিত করেন। শিশুপাঠ সহজ কোনো বিষয় নয়। আমার সন্তান স্কুল ভবনের ফটক পেরুতেই বলল, আমি এই স্কুলে পড়বো না মা। আমার শিশুর কণ্ঠে স্পষ্ট ধিক্কার! সংশ্লিষ্টসহ সব মহলকে বিষয়টি ভাববার জন্য অনুরোধ করছি। আমার সন্তান আপনারে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছে, এই লজ্জা কার!
লেখক: আলোকচিত্রী
                
              
																                  
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    






































