দেশে সম্প্রতি একজন চিত্রনায়িকা, দুইজন কথিত মডেল, ক্ষমতাসীন দলের একজন বহিষ্কৃত নেত্রীসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে আরও কয়েকজনকে। এ-সংক্রান্ত খবর বারবার প্রকাশিত হচ্ছে সংবাদমাধ্যমে। বিশেষ করে চিত্রনায়িকা পরীমনি গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় চলছে বিস্তর আলোচনা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানিয়েছে পরীমনির বাড়ি থেকে মদ আর মাদক উদ্ধার করা হয়েছে। অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন, আরও আগেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন? যাদের প্রশ্রয়ে এবং পৃষ্ঠপোষকতায় সমাজে মাদকসংশ্লিষ্ট অপরাধ এবং মানুষকে ব্ল্যাকমেল করে অর্থ আদায়ের মতো অন্যায় ঘটে, সেই প্রভাবশালী ব্যক্তিদেরও কেন আটক করা হচ্ছে না? এমন প্রশ্ন উঠে আসছে। গ্রেপ্তারদের অপরাধ কতটা গুরুতর, তা জানার জন্য সুষ্ঠু তদন্ত হোক, কিন্তু গ্রেপ্তার করার সঙ্গে সঙ্গেই সোশাল মিডিয়ায় তাদের সম্পর্কে কুরুচিকর আলোচনায় মেতে ওঠা সমর্থনযোগ্য নয় এমন মতও প্রকাশ করা হয়েছে।
কিন্তু ‘সোশ্যাল মিডিয়া ট্রায়াল’ তো আমাদের সমাজে নিয়মিত ব্যাপারেই পরিণত হয়েছে। এমন আচরণ কাম্য নয় বললেই কি অনেকে এমন আচরণ করা থেকে বিরত থাকবে? কেন বহু মানুষের মধ্যে অপরকে নিয়ে অরুচিকর আলোচনায় মেতে ওঠার প্রবণতা তৈরি হয়েছে, তার কারণ বিশ্লেষণ করার প্রতি কি মনোযোগী হচ্ছি আমরা? ইদানীং দেখতে পাচ্ছি সমস্যা নিয়েই কেবল কথা বলা হয়। কিন্তু কেন সমস্যা তৈরি হয়েছে এবং টিকে আছে, তা বিশ্লেষণ করা হয় না। আমাদের সমাজে ফেসবুকে প্রায়ই চোখে পড়ে বহু অশ্লীল মন্তব্য, দেখা যায় অপরের প্রতি বিষোদগার করে দেওয়া পোস্ট, যেখানে থাকে অশোভন বাক্য। চিন্তাশীল কোনো বিষয় নিয়ে দেওয়া পোস্টে আলোচনা করার আগ্রহ যত না দেখা যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি উৎসাহ আর মাতামাতি দেখা যায় চটুল আর চাঞ্চল্যকর কোনো পোস্টে মন্তব্য করার প্রতি। আবার কখনো কোনো ব্যাপারে সমালোচনাও করা হয় এমন কোনো ছবি বা পোস্ট দিয়ে যা ঝাঁঝালো এবং শাণিত প্রতিবাদ প্রকাশ তো করেই না, বরং তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ এবং শ্লেষের পরিবর্তে তা হয়ে ওঠে হালকা হাসিঠাট্টা এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় অহরহ দেখতে পাওয়া বহু গভীরতাহীন উপাদানেরই অনুরূপ। তারল্য-নির্ভর এমন ছবি বা পোস্ট মানুষের মনে অভিঘাত যেমন তৈরি করতে পারে না, তেমনি যাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা হচ্ছে তাদের জন্য তীব্র অস্বস্তি তৈরি করাও সম্ভব হয় না।
সংবাদমাধ্যমে ‘সেনসেশনালিজম’কে প্রাধান্য দেওয়ার নিন্দা করা হয় সব সময়ই। কিন্তু আমাদের দেশে এখন যতটুকু প্রয়োজন তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে উত্তেজনাপূর্ণ এবং চাঞ্চল্যকর খবর প্রচার করার ঝোঁক দেখা যায় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমেই। তথ্য জানানো এবং বিনোদন দেওয়া যেমন গণমাধ্যমের কাজ, পাঠক/দর্শককে বিভিন্ন বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান দেওয়ার মাধ্যমে তাদের মধ্যে যুক্তিবোধ, দায়িত্বশীলতা, এবং সুরুচি সৃষ্টি করাও গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। জনগণের মধ্যে সুরুচি না থাকলে সমাজ যেহেতু সুন্দর হয়ে উঠবে না, তাই জনরুচির মান বাড়ানোর কাজ দায়িত্বশীলতার সঙ্গে করা প্রয়োজন। সেই দায়িত্ব কি আমাদের সংবাদমাধ্যম সচেতনভাবে পালন করছে? সাংস্কৃতিক উপাদান এবং সামাজিক চর্চায় অগভীরতা এবং স্থূলতা বাড়তে থাকার বাস্তবতার কার্যকর সমালোচনা কি করছেন বুদ্ধিজীবী এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা? দায়িত্ব পালনে ঘাটতির প্রতি মনোযোগ না দিয়ে কেবল সমাজে কদর্যতা বাড়ছে কেন, তা নিয়ে হা-হুতাশ করলে স্বাভাবিকভাবেই কোনো সুফল আমরা আশা করতে পারি না।
কার্ল মার্কসের একটি বক্তব্যের সুন্দর অনুবাদ করেছিলেন প্রখ্যাত কবি সমর সেন―জীবনধারার ছাপ চেতনাকে গড়ে, চেতনার ছাপ জীবনধারাকে নয়। যে পারিবারিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে আমাদের সমাজে কমবয়সীরা এখন বেড়ে উঠছে এবং আমরা বসবাস করছি, সেই জীবনধারা কি সুরুচি এবং বিবেচনাবোধ সৃষ্টিতে সাহায্য করছে? ফরাসি তাত্ত্বিক জঁ বদরিলা উল্লেখ করেছেন উত্তর-আধুনিক সময়ে বিভিন্ন সামাজিক আচরণ যেন হয়ে উঠেছে কোনো খেলা, যেখানে প্রাধান্য পাচ্ছে জাঁকজমক। চিন্তাবিদ জিগমুন্ত বম্যানও এই সময়ে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করার প্রতি মানুষের তীব্র আকাঙ্ক্ষার কথা উল্লেখ করেছেন। অন্যের দৃষ্টি কাড়ার চেষ্টা প্রায়ই যেন হয়ে উঠছে উদ্ভট প্রদর্শনীর মতো। অতীতে সামাজিক এবং রাজনৈতিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য রাজপথে করা ক্রুদ্ধ মিছিলের স্থান এখন দখল করেছে ‘ফ্ল্যাশ মব,’ যেখানে কিছু মানুষ রাস্তায় সমবেত হয়ে পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণের মতো কিছু করে সরে যায়। কিন্তু তা কি দর্শককে সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন করতে পারে? প্রতিবাদ করার জন্যই যে এই আয়োজন সাধারণ মানুষ অনেক ক্ষেত্রে তা না-ও বুঝতে পারেন কারণ ‘ফ্ল্যাশ মব’-এর রূপ প্রায়ই হয়ে ওঠে কোনো খেলা বা আকর্ষণীয় এক প্রদর্শনীর মতোই।
১৯৬৯ সালে আর্জেন্টিনার দুইজন চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক ফার্নান্দো সোলানাস এবং অক্টাভিও গেটিনো তাঁদের আলোচিত ম্যানিফেস্টো ‘টুয়ার্ডস আ থার্ড সিনেমা’তে লিখেছিলেন পুঁজিবাদী সমাজে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করা হয় যখন প্রতিদিনই বুর্জোয়া গোষ্ঠীর কিছু উত্তেজনার প্রয়োজন হয়। এমন পরিবেশে বিদ্রোহ, প্রথাবিরোধিতা, সিস্টেমের প্রতি অসন্তোষও মানুষকে কেবল দৈনন্দিন উত্তেজনাই জোগায়। তা হয়ে ওঠে বাজারের অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের মতোই। তাঁরা আরও লিখেছেন, যৌক্তিকভাবে এবং চিন্তাশীলতার সঙ্গে করা না হলে প্রতিবাদ এবং ক্ষোভের প্রতি মানুষ হবে উদাসীন, এমনকি মানুষের কাছে তা বিনোদনমূলকও হয়ে উঠতে পারে। আমাদের সমাজে এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় যে লঘুতা-সর্বস্ব প্রতিবাদ আমরা দেখি প্রায়ই তা কি মানুষকে কেবল মামুলি উত্তেজনা আর কখনো বিনোদনই জোগাচ্ছে না? সমাজে অগভীর চিন্তার বিস্তৃতি ঘটছে নাটক-চলচ্চিত্রের উপাদানের মাধ্যমেও। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের বিভিন্ন চলচ্চিত্রে, ওয়েব সিরিজেও আকর্ষণীয়ভাবে দেখানো হয়েছে কখনো সুইমিং পুলের পাশে পার্টিতে, কখনো বারে মদ্যপানের দৃশ্য। বাংলাদেশে কজন মানুষ এমন পার্টিতে অংশগ্রহণ করে, বা বারে গিয়ে মদ্যপান করে, যার কারণে আমাদের নাটক-চলচ্চিত্রে এমন দৃশ্য বারবার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে?
সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে গণমানুষের একতাবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমেই কেবল অন্যায়ের অবসান ঘটানো সম্ভব এমন জরুরি বক্তব্য এই ধরনের নাটক-চলচ্চিত্রে কখনোই আসে না। বরং চাকচিক্যময় এবং বিনোদননির্ভর নানা উপাদান আর কৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে ভোগবাদী সমাজকাঠামো টিকিয়ে রাখার ভূমিকাই পালন করে এমন নির্মাণ। অথচ আমাদের সমাজে এমন নাটক-চলচ্চিত্রই ব্যাপক প্রচার এবং ভূয়সী প্রশংসা পায়। ধর্মান্ধতার বিস্তার, রাজনৈতিক দুর্নীতি, শ্রেণি-বৈষম্য, ইতিহাস চেতনার অভাব, মধ্যবিত্তের জীবনে অনিশ্চয়তা প্রভৃতি জরুরি সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার চেষ্টা আমাদের বেশির ভাগ নাটক-চলচ্চিত্রে নেই, অথচ একশ্রেণির মানুষের বিলাসী জীবনযাপনের দৃশ্য আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরা হচ্ছে প্রায়ই। বর্তমান সময়ে বিভিন্ন অগভীর সাংস্কৃতিক উপাদান এবং সামাজিক চর্চার কারণে আমাদের সমাজে যে জীবনধারা তৈরি হয়েছে, তা মানুষের চেতনায় চিন্তাশীলতা যুক্ত করছে না। যদি বহু মানুষের আচরণে বিবেচনাশক্তি আর সুরুচির ছাপ আমরা দেখতে চাই তাহলে জীবনযাপনের এমন পরিবেশ পরিবর্তনের জন্যই আমাদের চেষ্টা করতে হবে। এমন চেষ্টা আমরা আন্তরিকভাবে করবো কিনা, সেটাই প্রশ্ন।
লেখক: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
                
              
																                  
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    






































