বাঙালি মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। ঈদ যদিও দুটি। তবু এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, ঈদুল ফিতরই সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। ঈদুল আজহায় পশু কোরবানির ব্যাপার থাকে বলে উৎসবে কিছুটা টান পড়ে। কিন্তু ঈদুল ফিতর মানে রোজার ঈদে বাংলার ঘরে ঘরে যেন উৎসবের, আনন্দের বান ডাকে। মুসলমানদের উৎসব হলেও, আনন্দ পৌঁছে যায় সবার ঘরে, সবার হৃদয়ে।
আগেই বলেছি, দুই ঈদে আনন্দের ধরন দুই রকম। এক মাসের সংযম সাধনা শেষে রোজার ঈদ আসে ছেড়ে দেওয়া স্প্রিংয়ের মতো আনন্দ নিয়ে। ঈদুল ফিতরের আনন্দটা যেন এক মাস ধরে তিলে তিলে জমে জমে আসে। আসলে রোজার শুরু থেকেই শুরু হয় ঈদের ক্ষণগণনা। কোরবানির ঈদের তারিখটা আগেই ঠিক হয়ে যায়। তবে রোজার ঈদ নিয়ে প্রতিবছরই একটা অনিশ্চয়তা থাকে, একদম আগের সন্ধ্যা পর্যন্ত। রোজার প্রস্তুতি নিয়ে শেষমুহুর্তে ঈদের প্রস্তুতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার ঘটনা অনেক ঘটেছে। ‘আজ চাঁদ দেখা গেলে কাল ঈদ’ সংবাদপত্রের এই শিরোনাম চিরকালীন। ঈদের তারিখ নিয়ে এবারও দোলাচল ছিল, এখনো আছে। ৩০ রোজা পূর্ণ হলে ঈদ হবে রোববার। কিন্তু সৌদি আরবে শুক্রবার ঈদ হচ্ছে বলে ধরেই নেওয়া যায় বাংলাদেশে শনিবার ঈদ হবে। আবহাওয়াবিদরাও বলছেন, শুক্রবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশের আকাশে শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা যাবে।
শনিবার বাংলাদেশে ঈদ হবে প্রায় নিশ্চিত, তবু চাঁদ দেখার ঘোষণা না আসা পর্যন্ত বাজবে না, ও মন রমজানের এই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
যাযাবর তার বিখ্যাত বই দৃষ্টিপাতে লিখেছিলেন, ‘বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ।’ ঈদের চাঁদ দেখা প্রসঙ্গ এলে এই কথাটা আমার সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হয়। ছেলেবেলায় ঈদের আনন্দ শুরু হতো চাঁদ দেখা থেকে। সবচেয়ে বেশি উত্তেজনা হতো ঈদের চাঁদ দেখা নিয়ে। ইফতারের পরপরই আমরা মসজিদ এলাকায় চলে যেতাম। কেউ মসজিদের ছাদে বা মিনারে উঠে যেতাম। এমনকি কেউ লম্বা গাছেও চড়ে বসত। মানে যেন চাঁদ দেখার জন্য আকাশের যত কাছে যাওয়া যায়। ঈদের চাঁদ এক চিলতে, থাকেও খুব অল্প সময়।
নিজের চোখে ঈদের চাঁদ দেখার আনন্দই অন্য রকম ছিল। আর যে প্রথম চাঁদের দেখা পেত, সে যেন চ্যাম্পিয়ন। আমি বলছি আশির দশকের কথা। তখন জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি ছিল কি না, জানি না। তবে কোনো বিভ্রান্তির কথা শুনিনি। ঈদের সিদ্ধান্ত নিতে মধ্যরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি। রেডিওতে ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ…’ শুনলেই বুঝতাম ঈদ চলে এসেছে। এখন বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির এতটাই অগ্রগতি হয়েছে যে শুধু আগামী মাসের নয়, আগামী অনেক বছরের চাঁদ ওঠার দিনক্ষণ বলে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু সমস্যা হলো, ধর্ম বিজ্ঞান দিয়ে চলে না। আকাশে চাঁদ উঠলেই হবে না। ইসলাম ধর্মমতে অন্তত দুজন মানুষকে নিজের চোখে চাঁদ দেখতে হবে।
ছেলেবেলার ঈদের আনন্দের কথা বলছিলাম। একটা নতুন জামা যে আনন্দ বয়ে আনত, এখন পুরো দোকান কিনে দিলেও ততটা হয় না। ঈদের নতুন জামা আমরা লুকিয়ে রাখতাম। কেউ দেখে ফেললেই ঈদের আনন্দ মাটি। ছেলেবেলায় ঈদ কার্ড বিতরণের একটা ব্যাপার ছিল। এখন সবকিছুই বদলে গেছে। প্রযুক্তি সত্যি আমাদের আবেগ অনেকটাই কেড়ে নিয়েছে।
ঈদের প্রধান আনন্দ হলো, আনন্দটা সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়া। ধনী-গরিব সবাই মিলে এক কাতারে ঈদের নামাজ আদায় করা, নামাজ শেষে কোলাকুলি করা মানে হৃদয়ে হৃদয় মেলানো। ইসলামে ঈদের ধারণাটাই হলো, ধনী-গরিবের বৈষম্য কমিয়ে আনা। জাকাত-ফেতরা এবং এমনিতে দানখয়রাত মিলিয়ে ঈদের আনন্দ সত্যি পৌঁছে যায় ঘরে ঘরে। ইদানীং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনও সুবিধাবঞ্চিতদের ঘরে ঈদের আনন্দ পৌঁছে দিতে নানা উদ্যোগ নেয়।
করোনা এবং যুদ্ধের কারণে গত কয়েকটা ঈদ পুরো আনন্দ নিয়ে আসতে পারেনি। যুদ্ধের প্রভাব এখনো আছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস দশা। তবে ঈদের বাজারে গিয়ে সেটা টের পাওয়া যায়নি পুরোপুরি। সব মার্কেটেই উপচে পড়া ভিড়। ঈদ সব মানুষের আনন্দের যেমন, তেমনি দেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক উপলক্ষ। কেনাকাটা, বাড়িফেরা, বিনোদন- সব মিলিয়ে ঈদ অর্থনীতিতে নতুন ঢেউ তোলে।
ঈদে ঢাকা থেকে কোটির বেশি মানুষ বাড়ি ফেরে। বাংলাদেশে ঈদে বাড়ি ফেরা মানেই যেন এক অন্তহীন ভোগান্তি। এবার ছিল উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। ছুটি লম্বা হওয়ায় মানুষ ধাপে ধাপে বাড়ি ফিরেছে। তাই ভোগান্তি ছিল না বললেই চলে। রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল, লঞ্চ টার্মিনাল, কোথাও ঈদের আমেজ টের পাওয়া যায়নি। রাস্তার উন্নয়ন, নতুন নতুন সেতু এবং ভালো ব্যবস্থাপনা এবার মানুষকে স্বস্তি দিয়েছে। দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে এবার আনন্দের ষোলোকলা পূর্ণ হয়।
তবে রোজার সময় বেশ কয়েকটি অগ্নিকাণ্ড, বিশেষ করে বঙ্গবাজার ও নিউ সুপার মার্কেটের আগুন হাজারো ব্যবসায়ীকে পথে বসিয়েছে। লাখো মানুষের ঈদের আনন্দকে ম্লান করে দিয়েছে। ঈদের আনন্দে যেন আমরা সেই মানুষগুলোকে ভুলে না যাই। যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী আমরা যেন ঈদের আনন্দটাই ভাগাভাগি করে নিই। একা আনন্দ করা নয়, সবাইকে নিয়ে উৎসব করাটাই ঈদের মূল চেতনা, সেটা যেন আমলা ভুলে না যাই।
লেখক: সাংবাদিক
 
                
              
 
																                   
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                    






































