র্যাব ও তার কর্মকর্তাদের ওপর সাম্প্রতিক মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর সরকার একটু ব্যাকফুটে চলে গেছে বলে মনে হচ্ছিল। অন্যদিকে সরকারবিরোধী মহলে, বিশেষ করে বিএনপি শিবিরে, একটু চাঙা ভাব দেখা যাচ্ছিল। দেশে-বিদেশে তাদের সমর্থক যে-বিশ্লেষকেরা আছেন তাঁরাও বেশ গা ঝাড়া দিয়ে বলতে শুরু করেছিলেন যে, দেশে দেশে ‘গণতন্ত্র’ ও ‘মানবাধিকার’ প্রতিষ্ঠার অঙ্গিকার নিয়ে ক্ষমতায় আসা মার্কিন প্রশাসন শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ‘কঠোর’ হতে শুরু করেছে। কেউ কেউ এর মধ্যে ‘অচিরেই’ ক্ষমতার পালাবদলের আভাসও খুঁজে পান।
সত্যি বলতে কি, আমজনতার মাঝে বিরোধীদের এ প্রচার একটু হলেও ভিত্তি পেয়েছিল। তা পাবে নাই বা কেন। এ ধারণা প্রায় সবার মাঝে এখনও বদ্ধমূল যে, ট্রাম্পের জায়গায় ২০১৫ সালে যদি হিলারি ক্লিন্টন জিতে যেতেন তাহলে আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতায় থাকা বেশ কঠিন হতো। এ ধারণাটার জন্ম হয়েছিল এ কারণে যে, ওবামা প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে হিলারি যেভাবে একটার পর একটা ইস্যু তুলে আওয়ামী লীগ সরকারকে তটস্থ রেখেছিলেন প্রেসিডেন্ট হলে তাঁর এ তৎপরতা কয়েকগুণ বেড়ে যেত। উৎসাহীজন চাইলে সেই সময়ে অবসরের বয়স অতিক্রান্তের পর গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ড. ইউনূসের অপসারণ, সরকারি বিধিবদ্ধ এ সংস্থায় যে কোনো মূল্যে ড. ইউনূসের কর্তৃত্ব বজায় রাখার চেষ্টা, বিশ্বব্যাংক কর্তৃক কথিত দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে সরে পড়া ইত্যাদি বিষয়গুলো আবার একটু স্মরণ করতে পারেন। আর যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্রেট নেতাদের, বিশেষ করে দলটির প্রভাবশালী গোষ্ঠীর সদস্য ক্লিন্টন দম্পতির সাথে ড. ইউনূসের ঘনিষ্ঠাতার কথা সবারই জানা।
মনে করা হয়, আওয়ামী লীগ সরকার তখন বেঁচে গিয়েছিল বাংলাদেশ নিয়ে ট্রাম্পের বিশেষ কোনো আগ্রহ না থাকার কারণে। উপরন্তু, ট্রাম্প দক্ষিণ এশিয়া প্রশ্নে ভারতের মোদি সরকারকে তাঁর পুরো শাসনকালে প্রায় ব্ল্যাংক চেক দিয়ে রেখেছিলেন। আর মোদি সরকারের সাথে আমাদের বর্তমান সরকারের সম্পর্ক কতটা উষ্ণ তা কারও অজানা নয়।
এখন যেহেতু, ২০২০ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পের পরাজয়ের পর, যুক্তরাষ্টের ক্ষমতায় বাইডেনের নেতৃত্বে ডেমোক্রেটরা আবার ফিরে এসেছে এবং ড. ইউনূসও বেশ সক্রিয় আছেন, তাই মানুষের মাঝে এ ধারণা ফিরে আসাটা স্বাভাবিক যে, বাইডেন প্রশাসনের সাথে শেখ হাসিনা সরকারের সম্পর্ক খুব মসৃণ যাবে না।
স্মরণ করা যেতে পারে, হিলারির নির্বাচনে সেখানকার বিএনপি নেতারা তো ছিলেনই, এখান থেকেও দলটির একদল নেতাকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছিল হিলারির পক্ষে কাজ করতে। সেবার অনেকটা বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো ট্রাম্প পাশ করায় বিএনপি খুব হতাশ হয়ে পড়লেও ২০২০ সালের নির্বাচনে বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ায় তারা খুব আশাবাদী হয়ে ওঠেন যে, এবার নিশ্চয় শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপি-উত্থাপিত ‘গণতন্ত্রহীনতা’ ও ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের’ অভিযোগগুলো হালে পানি পাবে।
কিন্তু বিএনপি শিবিরের সে আশার গুড়ে মনে হচ্ছে আবারও বালি ছিটিয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যকার সর্বশেষ ফোনালাপ। দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মাঝে কী আলাপ হয়েছে তা ইতিমধ্যেই মিডিয়ায় এসেছে। সেখানে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে এ বলে আশ্বস্ত করেছেন যে, র্যাব ও তার সাবেক-বর্তমান সাত কর্মকর্তার নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বাংলাদেশের যে উদ্বেগ তার সুরাহা হবে। দুই দেশের মধ্যে ইতিমধ্যে যেসব ফোরাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেখানে আলোচনার মাধ্যমে তা করা হবে।
শুধু তা নয়, ওই ফোনালাপের পরপরই বাইডেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হল যেখানে, বিশেষ করে জঙ্গি দমনের ক্ষেত্রে- খোদ র্যাবের কর্মকাণ্ডের বেশ প্রশংসা করা হয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর দিনে প্রকাশিত ‘কান্ট্রি রিপোর্ট অন টেরোরিজম ২০২০’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ কমার পাশাপাশি এ সংক্রান্ত তদন্ত ও গ্রেফতার বেড়েছে।
গত ১০ ডিসেম্বর র্যাপিড একশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং সংস্থাটির বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তার—যাদের একজন পুলিশের বর্তমান মহাপরিদর্শক বেনজির আহমেদ, যিনি বর্তমান দায়িত্ব পাওয়ার আগে র্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন—ওপর বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেয় মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়। এসব নিষেধাজ্ঞার কারণে একদিকে র্যাব যুক্তরাষ্ট্রে কোনো সম্পত্তির মালিক হতে পারবে না এবং কোনো মার্কিন সংস্থা বা কোম্পানি বা কর্মকর্তার সাথে কোনো আর্থিক লেনদেন করতে পারবে না। একই সাথে ওই সাতজন উক্ত নিষেধাজ্ঞা না ওঠা পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে পারবে না।
তবে নিষেধাজ্ঞার খবর পাওয়ার পর বাংলাদেশ সরকার বসে থাকেনি। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এর বিরুদ্ধে তারা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানায়। সর্বোপরি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঢাকার মার্কিন দূতকে তলব করে যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘একতরফা’ সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা চায়। ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশের এ ত্বরিত প্রতিক্রিয়া যুক্তরাষ্ট্রকে ভাবিয়ে তোলে। তারই বহিঃপ্রকাশ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেনকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি ব্লিনকেনের ফোন।
এ নিয়ে বিশ্লেষকেরাও ইতিবাচক সুরে কথা বলছেন। যুক্তরাষ্ট্রের এ নিষেধাজ্ঞাকে খুব গুরুত্বের সাথে নেওয়ার কিছু নেই, এমন কথাও কোনো কোনো বিশ্লেষক বলছেন। কেউ কেউ এমনও বলছেন, এই নিষেধাজ্ঞা বরং যুক্তরাষ্ট্রকেই ব্যাকফুটে ফেলে দেবে। তাদের অভিমত, নিষেধাজ্ঞার ফলে স্বয়ং যুক্তরাষ্ট্রে কতটা প্রভাব পড়বে সেটা চিন্তা করা উচিত। কারণ এগুলো নিয়ে ইতোমধ্যে তাদের ভেতরেই সমালোচনা শুরু হয়েছে।
র্যাবের নিষেধাজ্ঞায় সরকারবিরোধীদের চাঙা হওয়ার আরেকটি কারণ ছিল, এটি দেওয়া হয়েছিল বাইডেনের গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশের আমন্ত্রণ না পাওয়ার পরপর। ৯ ও ১০ ডিসেম্বর ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত ১১০ নেতার এ সম্মেলনে অনেক দুর্বল গণতান্ত্রিক দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও বাংলাদেশকে ডাকা হয়নি। তবে এতে শেখ হাসিনাবিরোধী দল ও মানুষেরা খুশি হলেও সম্মেলন কিন্তু বিশ্ব মিডিয়ায় খুব একটা প্রশংসা পায়নি।
খোদ যুক্তরাষ্ট্রে ভেতরেই প্রশ্ন উঠেছে, বাইডেন এ সম্মেলনকে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র প্রমোট করার চাইতে তাঁর অভ্যন্তরীণ সংকট মোকাবেলার কাজেই বেশি ব্যবহার করতে চেয়েছেন। মজার ব্যাপার হলো, সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে বাইডেন প্রশাসন পাকিস্তানকে বলেছে সেফ হ্যাভেন ফর টেরোরিজম, অথচ সেই পাকিস্তানকে তারা আমন্ত্রণ জানিয়েছে। অন্যদিকে, শ্রীলংকায় সম্পূর্ণ জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটা সরকার থাকলেও তাদেরকে সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
আসলে যুক্তরাষ্ট্র যে তার এক সময়কার দোর্দণ্ডপ্রতাপ অনেকাংশেই হারিয়ে ফেলেছে বাইডেন প্রশাসনের এসব এলোমেলো পদক্ষেপ তারই প্রমাণ। নাহলে গত ৫০ বছরের চেষ্টায় বহু ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক এখন, মার্কিন কর্মকর্তাদেরই ভাষায়, যে ‘বহুমাত্রিকতা’ ও ‘গভীরতায়’ পৌঁছেছে তাকে ‘সস্তা’ কিছু পদক্ষেপের মাধ্যমে দুর্বল করার ঝুঁকি কেউ নেয়?
এটা তো স্বীকার করতে হবে যে, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ এখন একটা শক্তি, অর্থনীতি তো বটেই, অন্যান্য দিক থেকেও। আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্যের জন্য ভারত মহাসাগরকে নিরাপদ রাখতে হলে বঙ্গেপসাগরকে অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। আর এক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। তাছাড়া, এ অঞ্চলে ভারত ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের পাশে কেউ নেই, প্রায় সবাই চীনের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। চীনের মোকাবেলায় ভারতের শক্তিকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে হলেও বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে টানা দরকার।
তবে এ হিসাবটা যুক্তরাষ্ট্র বোঝে বলেই মনে হয়। সেজন্যই সামনের দিনগুলোতে তাদের তরফ থেকে এক ধরনের ড্যামেজ কন্ট্রোলের চেষ্টা চলবে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। অবশ্য বাংলাদেশকেও বসে থাকলে চলবে না। সবার সাথে বন্ধুত্ব কারও সাথে বৈরিতা নয়- জাতির পিতা প্রতিষ্ঠিত এ পররাষ্ট্র নীতিকে অক্ষুণ্ন রেখেই তাকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সব ধরনের যোগাযোগ আরও বাড়াতে হবে। একই সাথে নিজেদেরই প্রয়োজনে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে আরও মজবুত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমরা প্রতিজ্ঞা করেছি ২০৪১ সালের মধ্যে একটা উন্নত দেশে পরিণত হবো। আর একটা একটা উন্নত দেশ মানে উন্নত গণতন্ত্র ও সর্বজনীন মানবাধিকারের নিরবিচ্ছিন্ন চর্চা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
                
              
																                  
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    






































