গাজীপুরে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের আড়ালে মাদক ব্যবসা, রোগীদের শারীরিক নির্যাতন, প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় রোগীদের ভর্তি রেখে অর্থ আদায় ও অনৈতিক কার্যক্রম চালানোর অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির মালিকসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। প্রতিষ্ঠানটির মালিক নাজনিন ফিরোজা বাঁধন (৩৫) মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রের আড়ালে মূলত চালাতেন টর্চার সেল।
বুধবার (৫ জানুয়ারি) সকালে এ বিষয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বসিলায় র্যাব-২-এর কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
এর আগে মঙ্গলবার (৪ জানুয়ারি) বিকেলে গাজীপুরের সদর উপজেলার ভাওয়ালে মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রটিতে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-২-এর আভিযানিক দল। অভিযানে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন।
গ্রেপ্তার হওয়া অন্যরা হলেন মনোয়ার হোসেন সিপন (৩১), মো. রায়হান খান (২০), দিপংকর শাহ দিপু (৪৪) ও জাকির হোসেন আনন্দ (২৭)।
এ সময় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রটি থেকে উদ্ধার করা হয় এক চিত্রনায়কসহ ২৮ জনকে। পাশাপাশি জব্দ করা হয় ৪২০ পিস ইয়াবা, নির্যাতনের কাজে ব্যবহৃত লাঠি, স্টিলের পাইপ, হাতকড়া, রশি, গামছা, খেলা পিস্তল ও কথিত সাংবাদিকের পরিচয়পত্র।
অভিযানে রোগীদের নির্যাতনের প্রমাণ ও মাদকদ্রব্য পাওয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রটির কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়।
র্যাব জানায়, গত ১ জানুয়ারি ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সমিতি’ র্যাব-২-এর কাছে অভিযোগ জানায়, একজন চিত্রনায়ক দীর্ঘদিন ধরে তাদের কার্যক্রমে অনুপস্থিত রয়েছেন। তারা খোঁজখবর নিয়ে জেনেছেন ওই চিত্রনায়ককে গাজীপুরে একটি মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রে আটকে নির্যাতন করা হচ্ছে। ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সমিতি’র অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে র্যাব সদর দপ্তর ও র্যাব-২-এর গোয়েন্দা দল খোঁজখবর নেয় এবং অভিযোগের সত্যতা পায়। এরই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রটিতে অভিযান চালিয়ে ভুক্তভোগী চিত্রনায়কসহ ২৮ জনকে উদ্ধার করা হয় এবং নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
র্যাব আরও জানায়, গ্রেপ্তার নাজনিন ফিরোজা বাঁধন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, ২০০৯ সালে প্রথম মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রটি অনুমোদনহীনভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরে ২০১৩-২০১৪ সালে সালে সাময়িকভাবে অনুমোদন পায় কেন্দ্রটি। বাঁধন নিজেই এই পুনর্বাসন কেন্দ্রটির মালিক ছিলেন এবং কেন্দ্রটির কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কর্মী ছিল চারজন। বর্তমানে রোগী ছিল ২৮ জন। যদিও কেন্দ্রটিতে ২০ জন রোগী থাকার অনুমোদন রয়েছে। পাশাপাশি দুইজন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কোনো চিকিৎসক সেখানে পাওয়া যায়নি।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রটিতে ভর্তি রোগীদের কাছ থেকে নাজনিন প্রতি মাসে ১০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা মাসিক চার্জ আদায় করত। সে ভবনটিতে এই মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ছিল, সেটির ভাড়া ছিল ৪০ হাজার টাকা।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আরও জানান, উদ্ধারকৃত ভুক্তভোগীদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, যেভাবে নিরাময় কেন্দ্র পরিচালনা করার কথা, চিকিৎসা দেওয়ার কথা, রোগীদের সেবা দেওয়ার কথা তার কিছুই এখানে হয় না। উল্টো চিকিৎসার নামে রোগীদের ওপর চালানো হতো শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন। রশির সাহায্যে ঝুলিয়ে শারীরিক নির্যাতন করা হত। এমনকি এখানে খাবারের মানও ছিল অত্যন্ত নিম্ন। মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র হলেও এর মালিক ও কর্মচারীদের তাৎক্ষণিক র্যাপিড ডোপ টেস্টের মাধ্যমে তাদের মাদকাসক্তির প্রমাণ পাওয়া যায়।
রোগীদের অবস্থা শোচনীয় বলে জানিয়ে অভিভাবকদের কাছ থেকে অধিক পরিমাণ অর্থ আদায় করাই মালিক বাঁধনের মূল উদ্দেশ্য। পাশাপাশি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের আড়ালে মাদক ব্যবসা পরিচালনা করাই তার মূল পরিকল্পনা ছিল বলে জানায় র্যাব।