• ঢাকা
  • শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

দখলের কবলে রাজধানীর ফুটপাত-ফুটওভার ব্রিজ


জাহিদ রাকিব
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৫, ২০২২, ০৯:৫৬ পিএম
দখলের কবলে রাজধানীর ফুটপাত-ফুটওভার ব্রিজ
ছবি: সংবাদ প্রকাশ

ঢাকার ফুটপাত আর ফুটওভার ব্রিজগুলো পথচারীদের দখলে থাকার কথা ছিল। ফুটপাত দিয়ে হাঁটা, আর ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে পারাপার হবে মানুষ। কিন্তু সরেজমিনে দেখা যায়, বাস্তবে এর উল্টো চিত্র। ফুটপাত উপেক্ষা করে প্রধান সড়ক ধরে হাঁটছে এবং চলতি যান থামিয়ে পারাপার হচ্ছে সাধারণ জনগণ। এর কারণ, রাজধানীর অধিকাংশ সড়কের ফুটপাত আর ফুটওভার ব্রিজ ভাসমান দোকান ও ভিক্ষুকের দখলে রয়েছে। এমনকি বেশ কিছু এলাকায় গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে ফুটপাত।

ফুটপাতের এরকম দখলে একদিকে চলছে, দিনে কোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্য, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের চলাচলে ভোগান্তি। এমন পরিস্থিতি যাদের দেখভাল করার কথা সে কর্তৃপক্ষ যেন দেখেও না দেখার ভান করছে।

নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, একটি নগরকে আদর্শ নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে হলে মানুষের নিরাপদ হাঁটার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে তা পুরোই ব্যতিক্রম। রাজধানীতে সাধারণ মানুষের হাঁটার ফুটপাত যেন একধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আধুনিক নগরী গড়ে তোলার জন্য সিটি করপোরেশনের প্রধান দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। দুই করপোরেশনের উচিত, আধুনিক নগরী গড়ে তোলার জন্য প্রথমে রাজধানীর সড়কের পাশে থাকা প্রতিটি ফুটপাত দখলমুক্ত করে নিরাপদে চলাচলকারী ফুটপাত গড়ে তোলা।

রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ততম এলাকাগুলোর মধ্য গুলিস্তান, মতিঝিল, পল্টন, শাহবাগ, নিউমার্কেট, ফার্মগেট, মিরপুর ও উত্তরা এলাকা সরেজমিনে দেখা যায়, প্রতিটি সড়কের ফুটপাত আর ফুটওভার ব্রিজ দখলের রাজত্ব। এসব এলাকায় সবচেয়ে বেশি মানুষের পদচারণা থাকে। যে কারণে এখানে দিন-রাত সবসময়ই মানুষের ভিড় থাকে। অথচ তারা স্বচ্ছন্দ্যে হাঁটার জন্য ফুটপাত ব্যবহার করতে পারছে না। শুধু ফুটপাত নয়, রাজধানীর ব্যস্ততম সড়কগুলো দখল করেও চলছে রমরমা ব্যবসা। 

দেখা গেছে, নিউমার্কেট এলাকায় ফুটপাতের অবৈধ দোকানের ভিড়ে চলাচলে নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন পথচারীরা। ফুটপাতে জায়গা না পেয়ে তারা ঝুঁকি নিয়ে যানবাহনপূর্ণ রাস্তায় নেমে হাঁটেন। ফুটপাত ছেড়ে রাস্তার কিনারা দিয়ে হাঁটছিলেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী রেদওয়ান পারভেজ। সংবাদ প্রকাশকে তিনি বলেন, ‘‘আজিমপুর থেকে সকালে হেঁটে কলেজে যাই। প্রতিদিন সড়ক পথে ধরে যাওয়া লাগে। যে ফুটপাতে আমাদের হাঁটার কথা, সেখানে দেখেন কেমন বাণিজ্য চলছে। উন্নয়নশীল দেশের রাজধানীর এটার একটা সমাধান এখন সময়ের দাবি।’’

সানজিদা ইসলাম এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটিতে ফার্মেসি বিভাগে পড়াশোনা করেন। থাকেন পান্থপথ ছাত্রী হোস্টেলে। প্রতিদিন ক্লাসে যাওয়ার জন্য ফুটপাত ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হয় তাকে। কিন্তু ফুটপাত ও ফুটওভার ব্রিজ দখলে থাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রধান সড়ক দিয়ে তাকে হাঁটতে হয়। 

সংবাদ প্রকাশকে তিনি বলেন, ‘‘ফুটপাত দখল থাকায় আমাদের সবসময় রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হয়। প্রায় সময়েই দেখি, পুলিশ তাদের উচ্ছেদ করে। কিন্তু পুলিশ চলে গেলে আবার নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। সরকারের কাছে দাবি করবো, ফুটপাতটা হচ্ছে পথচারীদের হাঁটার জায়গা, সেটা যেন আমরা নিরাপদভাবে ব্যবহার করতে পারি।’’

ফুটপাত ও ফুটওভার ব্রিজের এমন বেদখল হওয়ায় মানুষের চলাচলের পথ যেমন সংকুচিত হয়েছে, তেমনি অবৈধ স্থায়ী ও অস্থায়ী দোকানের দখলে থাকা এসব ফুটপাত ও ফুটওভার ব্রিজে পথচারীদের হাঁটার সুযোগ কমই মেলে। সেখানে ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের পসরা আর ক্রেতাদের ভিড় লেগেই থাকে। নগর প্রশাসন বিভিন্ন সময় এমন অবৈধ গড়ে উঠা স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান পরিচালনা করলেও তা টেকসই হয় না।

এদিকে অবৈধ জায়গা দখলমুক্ত ও সংস্কার করতে প্রতি বছর দুই সিটি করপোরেশন কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে। মাঝেমধ্যেই সংস্থা দুইটি এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করে। প্রতিটি অভিযানে ন্যূনতম ৫ হাজার থেকে লক্ষাধিক টাকাও খরচ হয়। 

উত্তর সিটির (ডিএনসিসি) সংশোধিত বাজেট অনুযায়ী, সংস্থাটি ২০২০-২১ অর্থবছরে রাস্তা, ফুটপাত ও ড্রেন উন্নয়নে ব্যয় করেছে ১৯০ কোটি টাকা। দক্ষিণ সিটি (ডিএসসিসি) ব্যয় করেছে ৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। তবে ফুটপাত উন্নয়নে এ অর্থ খরচের সুফল পাচ্ছেন না নগরবাসী।

রাজধানীর আরেক ব্যস্ততম এলাকা গুলিস্তানের চিত্র আরো ভয়াবহ। সেখানে ফুটপাত দখলের পর প্রধান সড়কের একটা অংশও দখল করছে ভাসমান হকাররা। তাদের দখলে যাওয়ায় এই পথে চলাচল করা সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে কয়েকগুণ। 

ফুটপাত ও ফুটওভার ব্রিজ দখলে থাকা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফুটপাতের প্রতি ইঞ্চি করে জায়গা ভাড়া দিতে হয়। প্রতিটি এলাকার ফুটপাত ও রাস্তা সোনার চেয়েও দামি। হকার ও ফুটপাত ব্যবসায়ীদের রাস্তায় পণ্য বিক্রির সুযোগ দিয়ে ভাড়া আদায় করা হয়। পুলিশ, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা ও স্থানীয় কিছু মাস্তানের মধ্যে প্রতিদিন ওই টাকা ভাগাভাগি হয়।

এ ব্যাপারে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি সংবাদ প্রকাশকে বলেন, ‘‘অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও ফুটপাত দখলমুক্ত করার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। দখল হওয়া ফুটপাত উদ্ধারে আমরা এখন থেকে ফুটপাতে পাশে রেলিং করে দিবো। পাশাপাশি দখল হওয়া ফুটওভার ব্রিজগুলোতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করবো। অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’’ 

অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ সংবাদ প্রকাশকে বলেন, ‘‘ফুটপাত দখলরোধে আমাদের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত আছে। কিন্তু আজ ফুটপাত থেকে উচ্ছেদ করলে কাল আবার বসছে। এজন্য মেয়র মহোদয় এমন একটা সমাধানের কথা ভাবছেন, যাতে হকাররাও ক্ষতিগ্রস্ত না হন পথচারীদেরও সমস্যা না হয়। তবে নীতিমালায় হাঁটা ছাড়া ফুটপাত অন্য কাজে ব্যবহারের সুযোগ নেই। তাই বিষয়টা নিয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করছেন।’’

ফুটপাত ও ফুটওভার ব্রিজ দখল নিয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ মোবাশ্বের হোসেন সংবাদ প্রকাশকে বলেন, ‘‘যে শহরে জনগণ আনন্দের সঙ্গে হাঁটতে পারে, সে শহর হচ্ছে একটি সভ্য শহর। কিন্তু আমাদের শহরে বসবাস করা কোনো নাগরিক কি সে সুবিধা পাচ্ছে? শহরের প্রায় সব ফুটপাতে এখন দখল বাণিজ্য চলছে। ঢাকার দখল হওয়া ফুটপাত ও ফুটওভার ব্রিজ শুধু উচ্ছেদ অভিযানের মাধ্যমেই সমাধান সম্ভব নয়। দখলমুক্ত করার পর ফের যাতে বেদখল না হয় সেজন্য নগরবাসীকেও সচেতন হতে হবে।’’

জাতীয় বিভাগের আরো খবর

Link copied!