• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৭ মে, ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ৮ জ্বিলকদ ১৪৪৫
মুক্ত হননি নাবিকরা

কেঁদে জায়নামাজ ভেজাচ্ছেন বাবা-মা


সংবাদ প্রকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: এপ্রিল ৬, ২০২৪, ০৫:৩১ পিএম
কেঁদে জায়নামাজ ভেজাচ্ছেন বাবা-মা
ছেলের ছবি হাতে নাজমুল হকের মা। ছবি : প্রতিনিধি

সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি ২৩ নাবিক ও ক্রুদের মুক্তি মিলছে না ঈদের আগে। তাই পরিবারের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার সুযোগ নেই কারও। এসব নাবিকের বাড়িতে ঈদের আনন্দ ম্লান হয়ে গেছে। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় কাটাচ্ছেন স্বজন প্রিয়জনরা। অপহৃত নাবিকদের মধ্যে একজন ডেক ক্যাডেট মো. সাব্বির হোসেন।

টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার ডাঙা ধলাপাড়া গ্রামের হারুন অর রশিদের ছেলে সাব্বির হোসেন। গত বছরেও ঈদ করেছেন পরিবারের সঙ্গে। তবে এবারের চিত্র একেবারেই ভিন্ন।

অপহৃত হওয়ার পর থেকেই ছেলের মুক্তির অপেক্ষায় কেঁদে কেঁদে সময় পার করছেন সাব্বিরের বৃদ্ধ মা-বাবা। সন্তানকে সুস্থ শরীরে ফিরে পেতে নামাজ আদায় করছেন। মাঝেমধ্যেই একবার ছেলের ছবির দিকে, আরেকবার মোবাইলে দিকে তাকাচ্ছেন কোনো ভালো সংবাদ এলো কি না। চেয়েছিলেন ঈদের আগেই যেন ছেলে মুক্তি পায়। কিন্তু অপেক্ষার প্রহর শেষই হচ্ছে না। ঈদের প্রস্তুতি কিংবা কেনাকাটা কোনোটাই হয়নি নাবিকদের পরিবারে।

সাব্বির হোসেন। ছবি : সংগৃহীত

সাব্বিরের মতোই ঈদের আনন্দ ম্লান হয়ে গেছে অপহৃদ ২৩ নাবিক ও ক্রুর পরিবারে। চরম উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় দিন পার করছেন তাদের বাবা, মা, স্ত্রী, সন্তান, ভাই, বোনেরা। 

জিম্মি হওয়াদের আরেকজন নাবিক নাজমুল হক। তার পরিবারেও নেই ঈদের আনন্দ। গত ১২ মার্চ অপহৃত হওয়ার পর থেকেই ছেলের মুক্তির সংবাদের প্রতীক্ষায় সময় পার করছেন নাজমুল হকের মা-বাবা ও আত্মীয়-স্বজনরা। সন্তানকে ফিরে পেতে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করে সময় পার করছেন। আর মাঝে মধ্যেই ছেলের ছবি দেখছেন। প্রতীক্ষার প্রহর যেন তাদের শেষ হতে চাইছে না। তারা চান ঈদের আগেই যেন তার সন্তানের মুক্তি মেলে। কিন্তু সেই সম্ভাবনা অনেক ক্ষীণ। জাহাজ ছিনতাই হওয়ার পর নাজমুল হকের ভাগ্যে কী ঘটছে? সেই শঙ্কায় ঈদের আনন্দ ও আমেজ নেই তার পরিবার ও স্বজনদের মাঝে। অপেক্ষায় আছে কখন জিম্মি দশা থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে আসবে মা-বাবার বুকে।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে নাজমুলের মা নার্গিস বেগম বলেন, “মোবাইলটা সবসময় কাছেই রাখি। কখন শুনতে পাব আমার ছেলে মুক্তি পেয়েছে। ছেলের একটি ফোনের আশায় এখন দিন কাটছে।”

নাবিক নাজমুলের মা নার্গিস বেগম বলেন, “এবার ঈদে আমাদের ছেলের বাড়িতে আসার কথা ছিল। বলেছিল, মা ঈদে বাড়ি যাব। ছুটি নিয়ে সবাই মিলে ঈদ করব একসঙ্গে। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস, ছেলে আমার হাজার-হাজার মাইল দূরে জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হয়ে আছে। বাড়িতে নেই ঈদের আনন্দ। ছেলেকে ফিরে পাওয়ার আশায় প্রহর গুনছি।”

নাজমুলের মা বলেন, “নাজমুলের আয়েই আমাদের সংসার চলে। মাসে ৯০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পাঠাতো। জিম্বি হওয়ার আগের মাসে ৯১ হাজার টাকা দিয়েছে। আমার ছেলেটা এখনো বিয়ে করেনি। নাজমুল অনার্সে ভর্তির পরেই চাকরি হয়েছে। চাকরি হওয়ার পরে প্রথমে গিয়ে ৩ বছর ছিল। এরপর এসে আবার মাস তিনেক হলো গেছে। ঢাকা থেকে বিমানে দক্ষিণ কোরিয়া গিয়ে ওখান থেকে জাহাজে উঠেছে নাজমুল।”

নার্গিস বেগম বলেন, “আমাদের মাঝে ঈদের আনন্দ নেই। ছেলেকে দ্রুত ফিরে পেতে চাই। সরকার যেন দ্রুত ঈদের আগেই আমার ছেলেসহ অন্যদের দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়, সেই দাবি ও অনুরোধ করছি। ছেলেকে ছাড়া কিছুই ভালো লাগছে না। কবে ফিরবে আমার বুকের ধন?”

নাজমুল হকের বাবা-মা। ছবি : সংগৃহীত

জলদস্যুদের হাতে জিম্মি নাজমুল হক সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার ভদ্রঘাট ইউনিয়নের প্রত্যন্ত চর-নূরনগর গ্রামের আবু শ্যামা ও নার্গিস দম্পতির একমাত্র ছেলে।

জিম্মি নাজমুল হকের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঈদকে সামনে রেখে তাদের পরিবারে হচ্ছে না কোনো ধরনের কেনাকাটা। নেই ভালো কিছু রান্নার প্রস্তুতিও। অন্যবারের ঈদগুলো হাসি-খুশির থাকলেও এবার ঈদ তাদের কাছে নীরব কান্নার। একইসঙ্গে বয়ে বেড়াচ্ছে শঙ্কা ও প্রতীক্ষা। পরিবারের উপার্জনশীল প্রিয় ব্যক্তি বন্দিদশায় মহাসাগরে তলিয়ে গেছে তাদের ঈদ আনন্দ। প্রধানমন্ত্রীর কাছে ঈদুল ফিতরের আগেই ২৩ নাবিকের মুক্তির আকুতি জানিয়েছেন নাজমুলের স্বজনেরা।

এদিকে, ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহর দুই নাবিক ছালেহ আহমেদ (৪৩) ও আনোয়ারুল হক রাজুর (২৭) পরিবারেও নেই কোনো ঈদের আমেজ। ঈদকে সামনে রেখে কোনো ধরনের কেনাকাটা করছেন না তারা। দুই পরিবারের সবাই অপেক্ষা করছেন প্রিয় মানুষটির ফিরে আসার।

গত ১২ মার্চ বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে জিম্মি করে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। সেসময় জাহাজটিতে ২৩ জন নাবিক ছিলেন। তাদের মধ্যে ছালেহ ও রাজুর বাড়ি নোয়াখালীতে।

জিম্মি নাবিক ছালেহ আহমেদ ও আনোয়ারুল হক রাজুর পরিবার জানায়, প্রতিবার অনেক আনন্দ করে ঈদ পালন করা হলেও এবার কোনো আমেজ নেই। ঈদকে সামনে রেখে পরিবারের কেউ কেনাকাটা করছেন না। নেই ভালো কিছুর প্রস্তুতিও। দিন যত যাচ্ছে ততই শঙ্কা এবং উৎকণ্ঠা বাড়ছে। যোগাযোগ না থাকায় পরিবারের কেউ তাদের অবস্থাও জানতে পারছে না। দুই জিম্মির পরিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ঈদুল ফিতরের আগে ২৩ নাবিককে মুক্ত করার আকুতি জানিয়েছেন।

জিম্মি রাজুর বাঁ থেকে ভাই রনি, বোন কামরুন নাহার রুমি ও মা দৌলত আরা বেগম। ছবি : সংগৃহীত

দস্যুদের হাতে জিম্মি ছালেহ আহমেদ নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার সিংবাহুড়া গ্রামের মৃত সাখাওয়াত উল্যাহর ছেলে। পরিবারের চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। জাহাজের ফাইটার পদে কর্মরত ছিলেন তিনি।

স্ত্রী ও তিন মেয়েকে নিয়ে ছালেহ আহমদের পরিবার। সঙ্গে রয়েছেন মা, ভাই, বোন। তিনিই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ছালেহ আহমদ গত বছর ঈদ করেছেন কর্মস্থলে। পরিবারের আশা ছিল, এবার তাদের সঙ্গে ঈদ করবেন তিনি। কিন্তু, জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ার খবরে এলোমেলো হয়ে যায় ছালেহ আহমদের পরিবারের স্বাভাবিক জীবন। তিন মেয়েকে নিয়ে অনেকটা বাকরুদ্ধ তার স্ত্রী তানিয়া আক্তার। তিনি ছোট তিন মেয়েকে নিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন স্বামীর জন্য। একেবারে নিকট স্বজন ছাড়া কারও সঙ্গে কথা বলছেন না তিনি।

ছালেহ আহমদের স্ত্রী তানিয়া আক্তার বলেন, “এই ভেবে নিজেদের সান্ত্বনা দিচ্ছি। এখনো সময় আছে স্বামী ফিরবে। সরকার ২৩ জন নাবিককে ঈদের আগে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে আনবে এমন প্রত্যাশা করছি আমরা।”

জিম্মি ছালেহ  আহমদের স্ত্রী তানিয়া আক্তার। ছবি : সংগৃহীত

জলদস্যুদের হাতে জিম্মি আনোয়ারুল হক রাজু নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার রামপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের রামপুর গ্রামের আজিজুল হক মাস্টারের ছেলে।

আজিজুল হক মাস্টার বলেন, “দুই ভাই এবং এক বোনের মধ্যে রাজু সবার ছোট। গত নভেম্বরের শেষ দিকে রাজু সিঙ্গাপুর থেকে জাহাজে ওঠে। এরপর ছেলের বন্দিদশায় বদলে গেছে পরিবারের চিত্র। এবার বাড়িতে এসে ঈদ করার কথা ছিল রাজুর। ঈদের আগেই আমার সন্তানসহ সব নাবিকদের মুক্ত করার ব্যবস্থা যেন সরকার করে।”

এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে জিম্মি থাকা নাবিক ও ক্রুরা হলেন, ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আব্দুর রশিদ, চিফ অফিসার মোহাম্মদ আতিকুল্লাহ খান, দ্বিতীয় কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম চৌধুরী, তৃতীয় কর্মকর্তা মো. তারেকুল ইসলাম, ডেক ক্যাডেট মো. সাব্বির হোসেন, প্রধান প্রকৌশলী এএসএম সাইদুজ্জামান, দ্বিতীয় প্রকৌশলী মো. তৌফিকুল ইসলাম, তৃতীয় প্রকৌশলী মো. রোকন উদ্দিন, চতুর্থ প্রকৌশলী তানভীর আহমদ, ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান, ইলেকট্রিশিয়ান ইব্রাহিম খলিল উল্লাহ, এবি মো. আসিফুর রহমান, এবি সাজ্জাদ হোসেন, ওএস জয় মাহমুদ, ওএস আইনুল হক, অয়েলার মোহাম্মদ শামসউদ্দিন, মো. আলী হোসেন, ফায়ারম্যান মোশারফ হোসেন শাকিল, চিফ কুক মো. শফিকুল ইসলাম, ও জিএস মো. নূর উদ্দিন।

এদিকে, জলদস্যুর কবলে পড়া বাংলাদেশি জাহাজ ও নাবিকদের উদ্ধার প্রসঙ্গে শনিবার (৬ এপ্রিল) পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, “নাবিকরা ভালো আছেন, আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছে।”

জলদস্যুদের কবলে পড়ার পর এসআর শিপিং করপোরেশনের অফিসের সামনে ভিড় করেন স্বজনরা। ছবি : সংগৃহীত

চট্টগ্রাম নগরের দেওয়ানজি পুকুর লেন ওয়াইএনটি সেন্টারে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, “সর্বমুখী প্রচেষ্টা পরিচালনা করা হচ্ছে। যারা অপহরণ করেছে, তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে এবং তাদের খাবার-দাবারেরও কোনো অসুবিধা নেই। তারা কেবিনে আছেন। যেহেতু আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছে, আমরা আশা করছি, সহসা তাদের মুক্ত করা সম্ভব হবে।”

এর আগে গত ১২ মার্চ মোজাম্বিকের মাপুতো থেকে কয়লা নিয়ে আবার আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরে যাওয়ার পথে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়ে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’। জাহাজে ২৩ নাবিক রয়েছেন। যাদের সবাই বাংলাদেশি।

জলদস্যুদের কবলে পড়া জাহাজটি চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পগোষ্ঠী কবির গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিং করপোরেশনের। জাহাজটি সাধারণ পণ্য পরিবহন করে। ২০ মার্চ দুপুরে জলদস্যুদের প্রথম ফোন পায় মালিকপক্ষ।

Link copied!