বেলা সাড়ে ১১ টা। রাজধানীর মহাখালী কাঁচা বাজারের সামনে সিএনজি মোছামুছি করছিলেন ষাটোর্ধ্ব এক চালক। সিএনজির পাশ দিয়েই হেঁটে যাচ্ছিলেন পান-সিগারেটের ফেরিওয়ালা। ফেরিওয়ালাকে ডেকে সেই চালক দুই পদের জর্দা দিয়ে একটি পান কিনলেন। এরপর মুখে পান পুরে দিয়ে হাতে চুনভর্তি বোঁটা নিয়ে সিএনজি মোছামুছি করছিলেন, আর গুনগুন করে কি যেন বলছিলেন। আর একটু পরপর রক্তাভ পানের পিক ফেলছিলেন সিএনজির পাশেই। গালভর্তি পান, তার গালবেয়ে গড়িয়ে পড়ছে লালচে রস। কৌতুহলবশত এই চালকের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলাম। জানতে পারলাম নাম।
নাম তার মো. ছোবহান মোল্লা। বয়স ষাটের কাছাকাছি। দীর্ঘদিন ধরেই রাজধানীতে সিএনজি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি। আজ রোববার (৫ নভেম্বর) ভোর ৪ টায় সিএনজি নিয়ে সড়কে নেমেছেন। সকাল থেকে ভাড়াও মেরেছেন ৫০০ টাকা। তবে এই ভাড়ায় সন্তুষ্ট নন তিনি। কারণ, দুপুর ২ টার মধ্যেই তাকে সিএনজি জমা দিতে হবে গ্যারেজে। ভাড়াও দিতে হবে ৭৫০ টাকা। ভাড়া মেরেছেন ৫০০ টাকা। জমার টাকা মিলাতে এখনো ২৫০ টাকা বাকি। এছাড়াও নিজের জন্য পুরোটাই বাকি। পরিচয় গোপন রেখে তার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করলাম। জানতে পারলাম তার সিএনজি মোছমুছির রহস্য।
ছোবহান মোল্লা বললেন, “নিয়ম হলো সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সিএনজি চালাতে পারবেন। অর্থাৎ আধাবেলা। এরপর অন্যজন সিএনজি নিয়ে যাবেন চালানোর জন্য।”
তিনি বলেন, “আজ ভোর থেকে ভাড়া মেরেছি মাত্র ৫০০ টাকা। দুই ঘণ্টা ধরে বিভিন্ন রাস্তা ঘুরে মহাখালী আসলাম। এরমধ্যে কোনো যাত্রী পেলাম না। আজ বিএনপির ডাকা অবরোধের কারণে সকাল থেকেই যাত্রী তেমন নেই। দেশের যে অবস্থা শুরু হয়েছে, এ রকম যদি চলতে থাকে, তাহলে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ কিভাবে চলবে সেটাই বুঝতে পারছি না।
পরিচয় দিয়ে ছোবহান মোল্লার ছবি তুলতে চাইলে তিনি ‘না’ করেন। তিনি বলেন, “আপনি সাংবাদিক মানুষ। আমি যে কথাগুলো বলেছি মুখেই বলেছি। আপনি আর আমার ছবি নিয়েন না। আমার পরিবার আছে, সম্মান আছে একটা। যদি পারেন, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কথা বেশি বেশি করে লেখেন। রাজনৈতিক দলগুলো হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি থেকে যেন বের হয়ে আসে।”
অবরোধ নিয়ে এক পাঠাও চালকের সঙ্গে কথা বলছিলেন সিএনজি চালক আব্দুল কাদের। তিনি বলেন, “আমার সিএনজির মালিক একজন বিএনপি নেতা। অথচ তারাই অবরোধের ডাক দিয়ে আমাকে সিএনজি নিয়ে সড়কে পাঠিয়েছেন। আর তিনি ঘরে শুয়ে বসে দিন পার করছেন। আমি তাকে বললাম, স্যার কাল তো অবরোধ আপনারাই ডেকেছেন; আমি কি সিএনজি নিয়ে বের হবো? উত্তরে তিনি বললেন, গাড়ি গ্যারেজে রেখে কি লাভ।”
তিনি বলেন, “আমি সাধারণ মানুষ। দিনে আয় করে ব্যয় করি। একদিন বসে থাকা মানে আমার জন্য খুবই কষ্টকর। বিএনপি অবরোধ ডেকেছে ভালো কথা। কিন্তু তারাই এখন ঘরে বা অন্যখানে বসে আছে। অথচ রাজপথ ফাঁকা। অবরোধ ডেকে সাধারণ মানুষকে কষ্ট দেওয়া কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য বাহবা ডেকে আনবে না। আমাদের মতো জনগণ এখন রাস্তায় কষ্ট করছে শুধু তাদের জন্য। যার জবাব আল্লাহর কাছে ঠিকই দিতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “অনেকক্ষণ হচ্ছে এখানে দাঁড়িয়ে আছি, যাত্রী নেই। যাত্রী ছাড়া তো খালি গাড়ি দৌঁড়াইয়া নিয়ে লাভ নেই। হুদা গ্যাস পুড়ে আমারই লস। তাই বসে আর কি করি অবরোধে অলস সময় পার করছি। আর পাঠাও চালক ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করছি।”