• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬
ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা

বেসরকারি হাসপাতালে ব্যয় কয়েকগুণ বেশি


জাহিদ রাকিব
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৬, ২০২৩, ০৮:২৮ পিএম
বেসরকারি হাসপাতালে ব্যয় কয়েকগুণ বেশি
একটি বেসরকারি হাসপাতালের ডেঙ্গু রোগীর ওয়ার্ড। ফাইল ছবি

রাজধানীসহ সারা দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় সরকারি হাসপাতালগুলোতে যেমন রোগীর চাপ বেড়েছে, তেমনি চাপ বেড়েছে বেসরকারি হাসপাতালেও। এ কারণে শয্যা ফাঁকা না থাকায় অনেক বেসরকারি হাসপাতাল থেকেও ফিরে যাচ্ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা। আবার এসব হাসপাতালে রোগীরা পা রাখলেই খরচ বেড়ে যায় পাঁচগুণ।

সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গুর সাধারণ চিকিৎসায় এক রোগীর খরচ যেখানে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা, বেসরকারিতে সেখানে খরচ অন্তত কয়েক লাখ টাকা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, রাজধানীতে ৫৬টি বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি করা হচ্ছে। এসব হাসপাতালে এ পর্যন্ত সর্বমোট ২৬ হাজার ১২৯ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসব হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছে ১২৮ জনের। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু সংক্রমণ নিয়ে ভর্তি হয়েছে ৩৮৪ জন। বর্তমানে চিকিৎসাধীন আছেন ১৭শ ৫০জন।

সরজমিনে রাজধানীর নামকরা কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, এগুলোর কেবিন বা ওয়ার্ড খালি নেই। আবার যারা আসছেন, তারা অগ্রিম বেড বুকিং দিয়ে চলে যাচ্ছেন। 

হাসপাতালগুলোর ভর্তি শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রোগীদের সাধারণ ওয়ার্ড ও কেবিন ভাড়া আকাশচুম্বী। ভাড়ার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে সার্ভিস চার্জ ও ভ্যাট। এসব হাসপাতালে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা নেওয়ার সামর্থ্য নেই বললেই চলে।

ধানমন্ডি এলাকায় ল্যাবএইড হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, গত দুইদিন থেকে তাদের কোনো সাধারণ ওয়ার্ড ও কেবিন খালি নেই। আবার ডেঙ্গু আক্রান্ত অনেক রোগীর স্বজনদের অগ্রিম বেড বুকিং দিয়ে চলে যেতে দেখা গেছে। 

যারা ভর্তি আছেন তাদের ১০ জনের সাধারণ ওয়ার্ডে একজন রোগীকে প্রতিদিন সিট ভাড়ার জন্য খরচ করতে হয় ৬ হাজার টাকা। প্রতিটি কেবিনের জন্য গুনতে হয় ১২ হাজার টাকা। সঙ্গে আবার যুক্ত হয় সার্ভিস চার্জ ও ভ্যাট। সেই সঙ্গে ডেঙ্গু রোগীর বিভিন্ন পরীক্ষার খরচ ও ওষুধ ব্যয় তো আছেই।

ল্যাবএইডের পাশে অবস্থিত আনোয়ার খাঁন মেডিকেল কলেজের চিত্রও একই রকম। এখানে ডেঙ্গু রোগীদের ১৫ জনের একটি ওয়ার্ডে ১ বেডের জন্য রোগীকে গুনতে হয় ২ হাজার টাকা। কেবিন মান ভেদে ৫ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। আর আইসিইউতে ওষুধ ছাড়া ভাড়া গুনতে হয় প্রতিদিন ২৫ হাজার টাকা।

একই এলাকায় পাশপাশি থাকা সেন্ট্রাল হাসপাতালের চিত্রও একই রকমের। ডেঙ্গু রোগীদের ১৪ জনের ওয়ার্ডে ১ বেডের জন্য গুনতে হয় আড়াই হাজার টাকা। এসি সিঙ্গেল কেবিনের জন্য খরচ ৬ হাজার ৫০০টাকা। সুপার ডাবল এসি কেবিনের জন্য গুনতে হয় সাড়ে ১৫ হাজার টাকা।  

এসব হাসপাতালের মতো একই অবস্থা গ্রীণ লাইফ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের। এখানে ৫ জনের ওয়ার্ডে ১ বেডের ভাড়া দিতে হয় ৩ হাজার ২শত টাকা। ভিআইপি কেবিন ১৫ হাজার টাকা। আর সিঙ্গেল কেবিন ১০ হাজার টাকা।

ল্যাবএইড হাসপাতালে ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ভর্তি বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম। তার বড় ভাই জুনায়েদ ইসলাম সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “ডেঙ্গু নিয়ে এ বছর সবাই আতঙ্কে আছেন। এ কারণে প্রিয়জনদের কেউ ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে ভালো সেবার জন্য বেশি খরচ করে হলেও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে হয়। কিন্তু এখন দেখছি এখানে সরকারি হাসপাতালের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি চিকিৎসা খরচ।”

ল্যাবএইড হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আরিফুর রহমান সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “আমাদের হাসপাতালে প্রতিদিন ডেঙ্গু রোগী থাকে ৩০ থেকে ৪০ জন। যদিও ডেঙ্গুর জন্য ২৩টি সিট বরাদ্দ আছে। এখন আর ডেঙ্গু রোগীদের জন্য বিশেষায়িত বেড রাখা হচ্ছে না। যারাই আসছেন আমরা ভর্তি নেওয়ার চেষ্টা করছি। আজকে দুইদিন বেশি চাপ যাচ্ছে আমাদের। গতকাল থেকে শয্যা সংকটের কারণে নতুন কোনো রোগী ভর্তি নিতে পারছি না আমরা।”

ধানমণ্ডির গ্রীণ লাইফ হাসপাতালে কথা হয় ডেঙ্গু আক্রান্ত এক রোগীর স্বজন মনিরা সুলতানার সঙ্গে। তিনি সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “ভর্তির প্রথম দিনে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তাদের খরচ হয়েছে ৪২ হাজার টাকা।”

মনিরা সুলতানা আরও বলেন, “এখানে প্রতিরাতের স্ট্যান্ডার্ড সিঙ্গেল কেবিনের ভাড়া ১০ হাজার টাকা, ডাবল বেডের কেবিনে প্রতি বেডের জন্য ভাড়া চার-পাঁচ হাজার টাকা। এর সঙ্গে ওষুধ আর খাওয়ার খরচ তো আছেই। সব মিলিয়ে গত ১৫ দিনে তাদের প্রায় আড়াই লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে।”

ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের খরচ বেশি নিয়ে গ্রীণ হাসপাতালের জনসংযোগ কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “অতিরিক্ত খরচের আরেকটি কারণ প্লাটিলেট কমে যাওয়া। একই সঙ্গে অন্য কোনো জটিল রোগে ভুগছে বা অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন। এমন রোগীর ক্ষেত্রে প্লাটিলেট প্রয়োজন। রক্তের প্লাটিলেট ২০ হাজারের নিচে নেমে গেলে এক থেকে তিন ব্যাগ পর্যন্ত প্লাটিলেট দিতে হচ্ছে রোগীকে। ফলে রোগীদের ব্যয় একটু বেশি হচ্ছে।”

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ব্যয়বহুল খরচ জেনেই ভর্তি হচ্ছেন রোগীরা। তাছাড়া এসব হাসপাতালে সমাজের বিত্তশালীরাই  চিকিৎসা নিতে যায়। গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগ সরকারি ও বেসরকারি হসাপাতালের ২০৭ জন ডেঙ্গু রোগীর আট দিনের খরচের তথ্যের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায়, প্রত্যেক রোগীর  হাসপাতালভেদে আটদিনে সর্বনিম্ন ১০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ চার লাখ টাকা খরচ হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে এই খরচ দ্বিগুণও হয়।”

এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আরও  বলেন, “মানুষের মৌলিক চাহিদা চিকিৎসা সেবাটা যাতে ব্যবসায়ীক অধিক লাভের পণ্য না হয়ে যায়, সরকারের এই বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। পাশাপাশি বর্তমানে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু চিকিৎসার খরচ পর্যালোচনা করে কেউ অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা এবং ওষুধ কিনতে রোগীদের বাধ্য করছে কিনা সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখে জবাবদিহিতার আওতায় আনা জরুরি।”

Link copied!