দীর্ঘ চার বছরের বেশি সময় পর মিয়ানমারে গিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু নিয়ে আলোচনায় বসছে বাংলাদেশ। সোমবার (৪ সেপ্টেম্বর) মিয়ানমারের প্রশাসনিক রাজধানী নেপিডোতে দুই দেশের মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হবে। চীনের মধ্যস্থতায় ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগের আওতায় ডিসেম্বরের মধ্যে ছোট পরিসরে প্রত্যাবাসন শুরুর পথে প্রতিবন্ধকতা দূর এবং রোহিঙ্গাদের আস্থা স্থাপনের পদক্ষেপ নিয়ে দুই দেশের কর্মকর্তারা আলোচনা করবেন।
মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের একাধিক সদস্য গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানিয়েছেন। বৈঠকে যোগ দিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (মিয়ানমার অণুবিভাগ) মিয়া মো. মাইনুল কবিরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল গত শনিবার মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন গেছে।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মিয়ানমারের জান্তা ক্ষমতা দখলের পর বাংলাদেশ থেকে কোনো প্রতিনিধিদল এই প্রথম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনার জন্য গেল।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়ায় যুক্ত বাংলাদেশের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের রাখাইনে নিজেদের গ্রামে ফেরানোর বিষয়ে মিয়ানমার ইতোমধ্যে রাজি হয়েছে। এখন সেখানে ফিরে যেতে রোহিঙ্গাদের আস্থা ফেরাতে মিয়ানমার কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে এবং ভবিষ্যতে কী পদক্ষেপ নেবে, সে বিষয়টি আলোচনায় জোর দেবে বাংলাদেশ।
আস্থা ফেরানোর পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা জানান, প্রত্যাবাসনের পথে মূল অন্তরায় হচ্ছে রোহিঙ্গাদের মাঝে নিরাপত্তাহীনতার বোধ। তারা সেখানে (মিয়ানমারে) যেতে এখনো নিরাপদ বোধ করে না। তারা যদি নিরাপদ বোধ না করে, তাহলে বাংলাদেশ কোনো রোহিঙ্গাকে জোর করে রাখাইনে পাঠাবে না। স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও সম্মানের সঙ্গে প্রত্যাবাসনের প্রতিশ্রুতিতে বাংলাদেশ অনড় রয়েছে।
রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্যের মংডুতে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা রয়েছে। এ নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশের আরেক কর্মকর্তা জানান, রোহিঙ্গাদের জন্য রাখাইনের বেশ কিছু ঘরবাড়ি তৈরি করেছে মিয়ানমার সরকার। তবে তা ঘুরে দেখে এসে সেখানে যেতে অপারগতা প্রকাশ করেছে রোহিঙ্গারা। এখন তাদের আস্থা অর্জনে নেপিডো থেকে আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানানো হয়েছে। পদক্ষেপ অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পর এককালীন কিছু অর্থ দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে তাদের নিজ গ্রামে ফেরত যেতে দেওয়ার বিষয়টি মিয়ানমার নিশ্চিত করেছে। তবে শুরুতেই সেখানে যাওয়া যাবে না। পাইলট প্রকল্পের আওতায় প্রত্যাবাসনের শুরুতে রোহিঙ্গাদের জন্য তৈরি ঘরবাড়িগুলোতে থাকতে হবে। সেখান থেকে তিন মাসের মধ্যে তাদের নিজেদের গ্রামে স্থানান্তর করা হবে। এর মধ্যে কেউ যদি তৈরি ঘরবাড়িগুলোতে থেকে যেতে চায়, তবে সে ব্যবস্থাও করে দেওয়া হবে।
জানা গেছে, পাইলট প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে প্রায় তিন হাজারের বেশি রোহিঙ্গাদের একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা, সুরক্ষা ও মর্যাদার পাশাপাশি এ তালিকার রোহিঙ্গারা যাতে প্রত্যাবাসনের সময় পরিবার থেকে আলাদা না হয় এবং একই এলাকার রোহিঙ্গারা যাতে একসঙ্গে যেতে পারে, সে বিষয়টিতে বিশেষ খেয়াল রাখছে বাংলাদেশ। এ তালিকার বিষয়ে মিয়ানমার যদি সবুজ সংকেত দেয়, তাহলে সেখান থেকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু হবে। তবে প্রত্যাবাসন শুরুর আগে মিয়ানমার থেকে একটি প্রতিনিধিদল এসে এসব রোহিঙ্গার সঙ্গে আলোচনা করবে।
নেপিডোর আলোচনায় মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশ সফরের বিষয়টিও চূড়ান্ত হওয়ার কথা রয়েছে। ওই আলোচনার ধারাবাহিকতায় মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধিদল কক্সবাজারে এসে রাখাইনে ফিরে যেতে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলবে।
সম্প্রতি পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের জানান, পাইলট প্রকল্পের আওতায় প্রত্যাবাসনের জন্য ৩ হাজারের বেশি রোহিঙ্গার তালিকা করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে কতজনকে নেওয়া হবে, সেটি মিয়ানমারের ওপর নির্ভর করছে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট বিশ্ব মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সৃষ্ট বিশাল এক মানবিক সংকট প্রত্যক্ষ করে। রাখাইনে ওই দিন শুরু হওয়া সেনা অভিযানের পরের পাঁচ মাসে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। আর আগে থেকেই আছে প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা। এখন পুরোনো ও নতুন মিলিয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী ১২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।