ডিমের বাজারে বহুদিন ধরেই চলছে অস্থিরতা। দাম বাড়তে বাড়তে কখনও কখনও নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। আবার কিছু পদক্ষেপের ফলে খানিকটা সহনীয় পর্যায়ে চলে আসছে। গত কয়েক বছর ধরে বাজার চড়ে যাওয়ার কারণে সাধারণ ভোক্তারা বিপাকে পড়েছেন। অনেকে প্রোটিনের অন্যতম সস্তা উৎস ডিম কেনা কমিয়েই দিয়েছেন।
সরকারি তথ্যেই বলা হচ্ছে, দেশে ডিমের চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি। সিন্ডিকেটের কারণে দাম লাগামছাড়া হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন উল্টো কথা। তাদের মতে, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমে গেছে। ফলে দাম বেড়েছে।
বাজারের এমন তালগোল পরিস্থিতির মধ্যে কয়েকদিন আগে ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণে দেশের বাইরে থেকে চার কোটি ডিম আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আমদানির সেই খবরে বাজারে ডিমের দাম সামান্য কমে গেছে। যদিও প্রতিটা ডিম ১৪ টাকার নিচে কেউ কিনতে পারছেন না।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে দৈনিক ডিমের চাহিদা ৫ কোটি পিস। বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) হিসাব বলছে, দেশে দৈনিক ডিমের উৎপাদন হচ্ছে ৪ কোটি ৫ লাখ পিস। তারা বলছে, দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বন্যায় ডিমের উৎপাদন কমেছে ৫০ লাখ পিস। ফলে উৎপাদন ৪ কোটিতে নেমে যাওয়ায় ঘাটতি এক কোটি পিস ডিম।
তবে সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর দিচ্ছে ভিন্ন তথ্য। তারা বলছে, দেশে ডিমের দৈনিক উৎপাদন ৬ কোটি ৩০ লাখ পিস। বন্যার কারণে ডিমের উৎপাদন কমে গেছে ৫০ লাখ পিস। ফলে বর্তমান উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৮০ লাখ পিসে। সরকারের এই হিসাব ঠিক থাকলে ৮০ লাখ পিস ডিম উদ্বৃত্ত হয়।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বাৎসরিক তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১ হাজার ৮০৯ কোটি ৬০ লাখ পিস ডিমের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হয় ২ হাজার ৩৭৪ কোটি ৯৭ লাখ। ফলে উদ্বৃত্ত থাকে ৫৬৫ কোটি ৩৭ লাখ পিস ডিম। এর আগের অর্থবছরেও (২০২২-২৩) চাহিদা ১ হাজার ৮০৬ কোটি ৪৮ লাখের বিপরীতে উৎপাদন হয় ২ হাজার ৩৩৭ কোটি ৬৩ লাখ পিস। সে বছর উদ্বৃত্ত ছিল ৫৩১ কোটি ১৫ লাখ পিস।
প্রতি বছর উদ্বৃত্ত থাকা এই ডিমের দাম বেড়ে যাওয়া নিয়ে তাই তালগোল অবস্থা তৈরি হয়েছে। গেল এক মাস ধরে ডিমের বাজারের অস্থিরতায় কৃষি বিপণন অধিদপ্তর থেকে প্রতিটি ডিমের দাম ১১ দশমিক ৮৭ টাকা বেঁধে দেয়া হওয়। তবে তাতে বাজার নিয়ন্ত্রণে না এসে উল্টো দাম বাড়তেই থাকে। নিরুপায় হয়ে সরকার সাড়ে ৪ কোটি পিস ডিম আমদানির অনুমতি দেয়।
ডিমের দাম বাড়ার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, অপ্রত্যাশিত বন্যায় বাজারে মাছ, শাকসবজিসহ সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় ডিমের ওপর বাড়তি চাপ পড়েছে। যে কারণে ডিমের বাজারে সাময়িক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। শীতের শাকসবজি বাজারে এলেই ডিমের দাম কমবে।
দৈনিক ৬ কোটি ৩০ লাখ পিস ডিম উৎপাদনের বিষয়টি নিশ্চিত করে তথ্যে গরমিল বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ রেয়াজুল হক বলেন, “উৎপাদনকারীদের তথ্য ও সরকারের তথ্যের ফারাক হওয়ার প্রধান কারণ হলো, বেসরকারি হিসাবে হাঁস ও কোয়েলের ডিমকে আমলে নেওয়া হয় না। অথচ এই দুটি উৎস থেকে দৈনিক এক কোটির বেশি ডিম সরবরাহ চেইনে যুক্ত হয়।”
ব্রিডারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমানের ভাষ্য, বন্যার কারণে বর্তমানে ডিমের উৎপাদন চাহিদার চেয়ে কম। বাজারে সবকিছুর দাম বেশি হওয়ার ক্রেতাদের মধ্যে ডিমে বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়েছে।
বিপিআইসিসি বলছে, দেশে ডিমের উৎপাদনের ১৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ সরবরাহ করে বড় প্রতিষ্ঠান। বাকি ৮৬ দশমিক ০৪ শতাংশ সরবরাহ আসে ক্ষুদ্র খামারিদের থেকে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মতে, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বন্যায় বিধ্বস্ত ১৯টি জেলার ৫ হাজার ৯১৯টি পোল্ট্রি খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার বলেন, “বন্যায় হাজার হাজার খামার একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে কম দামে দ্রুত মুরগি বিক্রি করে দিয়েছেন। কারও কারও মুরগি মরে যাওয়ার কারণে পুঁজি হারিয়েছেন।”
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোলট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. বাপন দে বলেন, “আসলে চাহিদা উৎপাদনের পরিষ্কার তথ্য থাকা দরকার। সেটা না হলে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা সম্ভব না। ডিমসহ অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে তা নেই। আবার আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক না। ছয়-সাতবার ডিম হাতবদল হচ্ছে। আর প্রতিজনই লাভ নিচ্ছেন। ফলে উৎপাদনকারী কম লাভ পাচ্ছেন, কিন্তু ভোক্তা পর্যায়ে দাম বেড়ে যাচ্ছে।”
 
                
              
 
																
 
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                    




























