• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১১ অক্টোবর, ২০২৪, ২৬ আশ্বিন ১৪৩১, ৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

দ্বাদশ নির্বাচনে মনোনয়ন ‘আমলনামায়’ গুরুত্ব দিচ্ছে আ.লীগ


সফিকুল ইসলাম
প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৩, ২০২৩, ০৯:৫৭ পিএম
দ্বাদশ নির্বাচনে মনোনয়ন ‘আমলনামায়’ গুরুত্ব দিচ্ছে আ.লীগ

টানা তিন মেয়াদে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার। অনেকে মনে করছেন, তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকায় দেশের ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে কোনো সরকার দেশে এত উন্নয়ন করতে পারেনি। তবে নৌকার মনোনয়নে এমপি-মন্ত্রী হয়ে অনেকেই ব্যাংক খাত থেকে শুরু করে অন্যান্য খাতে ব্যাপক দুর্নীতিও করেছে। ইতোমধ্যে দুর্নীতির অভিযোগে দলের অনেকে শাস্তি পেয়েছে এবং বিভিন্ন মামলায় কারাগারে রয়েছে। এককথায় বলতে গেলে অনিয়ম-দুর্নীতি করলে কাউকেই ছাড় দিচ্ছে না শেখ হাসিনা সরকার।

এবার দলের ভেতরে থাকা (অপরাধী) দুর্নীতিবাজদের বিষয়ে আরও কঠোর হচ্ছেন শেখ হাসিনা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের আমলনামায় বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে আওয়ামী লীগ।

বৃহস্পতিবার (১২ জানুয়ারি) সংসদ ভবনে (সরকারি দলের সভাকক্ষে) অনুষ্ঠিত দলের সংসদীয় সভায় শেখ হাসিনা এমন মনোভাবের কথা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। এতে সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সভা শুরু হয় রাত ৮টায় এবং শেষ হয় রাত সাড়ে ৯টায়। দেড় ঘণ্টা ধরে চলা এই সভায় আরও কয়েকটি বিষয়ে উপস্থিত সংসদীয় কমিটির নেতাদের বিশেষ নির্দেশনা দেন দলীয় প্রধান।

শেখ হাসিনা বলেছেন, “আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আমলনামা দেখে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হবে। জনগণের সঙ্গে যাদের সুসম্পর্ক রয়েছে, যারা জনগণের পাশে দাঁড়ান, তারা নির্বাচনে মনোনয়ন পাবেন। আর যারা জনবিচ্ছিন্ন, এলাকার মানুষের সঙ্গে যাদের সুসম্পর্ক নেই, তাদের মনোনয়ন দেওয়া হবে না।”

বৈঠকে উপস্থিত থাকা সংসদীয় কমিটির কয়েকজন নেতা বলেছেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বিষয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, আগামী দ্বাদশ নির্বাচনে তিনি দলীয় প্রার্থীদের পাস করাবেন, এ ধারণা নিয়ে বসে থাকলে হবে না। এবারের নির্বাচনে সবাইকে নিজের যোগ্যতায় জিতে আসতে হবে।

দলের সংসদ সদস্যদের নিজ নিজ এলাকায় কার কী অবস্থান, তা জানতে জরিপ চলছে জানিয়ে দলীয় সভাপতি বলেন, “এমপিরা কর্মগুণে মনোনয়ন পাবেন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে আসা এমপিরা নির্বাচন কী, তা বোঝেন না, তাদের বুঝতে হবে।”

ওই নেতারা বলেন, “সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বিভিন্ন নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে মাঠে থাকা বিদ্রোহী প্রার্থী ও তাদের মদদদাতাদের প্রতীকী শাস্তির ব্যাপারে আলোচনা হয়। তবে যারা চিঠি দিয়ে অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইবেন, তাদের ক্ষমা করা হবে আগামী জাতীয় নির্বাচনে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য।”

সংসদীয় দলের সভা সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন, বিরোধী দলের আন্দোলনসহ সাম্প্রতিক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বলেন। সভায় বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্যও বক্তব্য রাখেন। বৈঠকে আওয়ামী লীগ সভাপতি আগামী নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের জন্য সার্ভে করেছেন বলে উল্লেখ করেন।

বিরোধী দলের আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করলে কোনো বাধা দেওয়া হবে না। তবে আন্দোলনের নামে ২০১৩-১৪ ও ১৫ সালের মতো সহিংসতা ও অগ্নিসংযোগ করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাদের কঠোর হস্তে দমন করা হবে।”

‘নৌকায়’ যে যোগ্যতা লাগবে

গত দুই বছর ধরেই বলা হচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবার সহজ হবে না। সেই হিসেবে ধরে নিয়েই দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে প্রস্তুতি নেওয়ার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে দলের মধ্যে থাকা অযোগ্যদের নিয়ে দ্বাদশ নির্বাচনে লড়তে চান না দলীয়প্রধান শেখ হাসিনা। তাই প্রার্থী নির্বাচনে সচেতনতা অবলম্বন করছে আওয়ামী লীগ। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এবার মনোনয়ন পেতে হলে চারটি যোগ্যতা নিশ্চিত থাকতে হবে আওয়ামী লীগ নেতাদের। আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতা এ তথ্য জানিয়েছেন।

যোগ্যতাগুলো হচ্ছে-

(১) নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশী স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয়তা কেমন, (২) দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক কতটুকু, (৩) এমপি থাকা অবস্থায় দায়িত্ব পালনে কোনো অনিয়ম-অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়েছেন কি না, (৪) আওয়ামী লীগের ভেতরে মনোনয়নপ্রত্যাশী ব্যক্তির কারণে দলে উপদল সৃষ্টি হয়েছে কি না।

এ চারটি বিষয়ে সংসদীয় আসনে যে নেতা কিংবা ব্যক্তি বেশি এগিয়ে থাকবেন, তাদেরই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয়ভাবে চূড়ান্ত মনোনয়ন পাবেন। তবে যাদের বিরুদ্ধে বিএনপি-জামায়াত লালন,সন্ত্রাস-অন্যের জমি দখল, বিদেশে অর্থ পাচার, রাতারাতি কোটিপতি বনে যাওয়া ব্যক্তিরা আর নৌকার মনোনয়ন পাবেন না।

এ বিষয়ে দলের সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যতম এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, “আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক পাওয়ার যোগ্য তারাই হবেন, যাদের এই চার যোগ্যতা রয়েছে। যাদের এই চার যোগ্যতার ঘাটতি থাকবে, তারা যত নামিদামিই হন নৌকার কান্ডারি হতে পারবেন না। এই চার যোগ্যতায় উত্তীর্ণ না হতে পারলে বর্তমান এমপিদেরও মনোনয়ন দেবেন না দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা।”

এ বিষয়ে কথা হয় আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ফারুক খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, “ব্যক্তি ভাবমূর্তি ও দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক—এই দুটি যোগ্যতা যাদের থাকবে, তারাই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নে বিবেচিত হবেন।”

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর দুজন ও সম্পাদকমণ্ডলীর তিনজন সদস্যের সঙ্গে কথা হয়।

তারা বলেন, “২০১৮ সালের নির্বাচনে কমপক্ষে ১০০ এমপিকে মনোনয়ন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রায় বাস্তবায়ন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ভেতরের একটি ‘প্রেশার গ্রুপ’ দলের সভাপতির সঙ্গে আলোচনায় বসে। তারা দলীয় প্রধানকে এ বার্তা দিয়েছিলেন যে এখন কোনো এমপিকে বাদ দিলে তারা দলের প্রার্থীকেই হারাতে উঠেপড়ে লেগে যাবেন। এই নিয়ে আরও কিছু যুক্তিও তারা শেখ হাসিনার কাছে তুলে ধরেন। ঝামেলা এড়াতে তিনি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। ওই পাঁচ নেতার দৃঢ় বিশ্বাস, আগেরবার সিদ্ধান্ত নিয়ে পিছিয়ে গেলেও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বর্তমান সংসদের দেড় শ এমপি বাদ পড়বেন।”

তারা বলেন, “দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার এবারের এমপি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত কোনো মহলই পরিবর্তন করতে পারবেন না। কারণ, প্রত্যেক এমপির ব্যাপারে বারবার তদন্ত করা হচ্ছে। নির্ভুল প্রতিবেদন পেতে এই উদ্যোগ।”

ওই নেতারা আরও জানান, দলের প্রত্যেক এমপির কর্মকাণ্ড নিয়ে আলাদা বই আকারে প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবনে সংরক্ষণ করে রেখেছেন। এ ছাড়া দলের অন্য নেতাদের বিষয়ে তিনি খোঁজখবর রাখছেন।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ বলেন, “আগামী দ্বাদশ নির্বাচনে বিভিন্ন দিক বিবেচনায় নিয়ে দল প্রার্থী মনোনয়ন দেবে। বর্তমান এমপিদের মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মনোনয়ন পাবেন না বলে তার বিশ্বাস। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাত-আট মাস আগে অনুষ্ঠিত সংসদীয় দলের সভায় পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, দ্বাদশ নির্বাচনে এক-তৃতীয়াংশ দলীয় এমপিকে আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হবে না। শুধু তা-ই নয়, বাদ পড়ার কারণ কী হবে তা-ও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন তিনি।”

Link copied!