দীর্ঘ সাত বছর পর আলোচিত ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় ওরফে নিলয় নীল হত্যা মামলার বিচার শুরু হয়েছে।
সোমবার (২২ আগস্ট) ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে নীলাদ্রির স্ত্রী আশামনির সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে এ বিচার শুরু হলো। সাক্ষ্য দিতে এসে সেদিন কী ঘটেছিল, তার বর্ণনা দেন আশামনি। তিনি জানান, ভরদুপুরে বাড়ি দেখার নাম করে এসেছিল হত্যাকারীরা। ঘরে ঢুকেই কোপাতে শুরু করে নীলাদ্রিকে। মৃত্যু নিশ্চিত করে চলে যাওয়ার সময় বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে যায় তারা। হামলার সময় তাকে পিস্তলের মুখে ঘরের বারান্দায় আটকে রাখা হয়েছিল।
জবানবন্দি দিতে আশামনিকে সহায়তা করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মো. শাহাবুদ্দিন মিয়া। আশামনি জানান, আক্রমণকারীদের কাউকে চেনেননি তিনি, এখনো চিনতে পারবেন না।
এক ঘণ্টা ধরে আদালতে সাক্ষ্য দেন মামলার বাদী আশামনি। এ সময় তাকে বেশ ভীত দেখাচ্ছিল।
আশামনি জানান, রাজধানীর খিলগাঁওয়ের পূর্ব গোড়ান টেম্পোস্ট্যান্ডের কাছে ৮ নম্বর রোডের ১৬৭ নম্বরের পাঁচতলা ভবনের পঞ্চম তলায় থাকতেন তারা। ওই দিন (২০১৫ সালের ৭ আগস্ট, শুক্রবার) দুপুর ১টা থেকে দেড়টার মধ্যে হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিল। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে বাজার থেকে ফিরে নীলাদ্রি ল্যাপটপ নিয়ে কাজে বসেছিলেন। তখন অপরিচিত এক ব্যক্তি এসে বলেন যে বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বলে তিনি বাসা দেখতে এসেছেন। ওই ব্যক্তির গায়ের রং শ্যামলা। কিন্তু তিনি বাসা দেখতে খুব সময় নিচ্ছিলেন। তারপর তিনি একটি বাটন ফোন বের করে কাউকে মেসেজ পাঠান।”
আশামনি বলেন, “এ ঘটনায় আমার সন্দেহ হয়। আমার স্বামী তাকে বলে, ‘আপনি কি বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বলেছেন?’ এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন লোক চাপাতি নিয়ে ঘরে ঢুকে আমার স্বামীকে কোপাতে শুরু করে। তার মাথার দুই দিকে দুটি চাপাতি দিয়ে দুই পাশে কোপ দেয়। পিস্তল ধরে অন্য একজন আমাকে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে আটকে রাখে। আমার চিৎকারে সে সময় কেউ এগিয়ে আসেনি। আমার বোন এ সময় রান্নাঘরে ছিল। যাওয়ার সময় তারা বাসার দরজা লাগিয়ে দিয়ে যায়। পরে আমাদের ভবনের কেউ একজন এসে দরজা খুলে দেয়।”
হত্যাকারীরা যাওয়ার সময় নীলাদ্রির ল্যাপটপ, মোবাইল নিয়ে যায়। সে সময় রক্তমাখা শার্ট ময়লার বালতির পাশে পড়ে ছিল। এক ঘণ্টা পর পুলিশ আসে বলে জানান আশামনি।
হত্যাকাণ্ডের দিনই আশামনি অজ্ঞাতপরিচয় চারজনকে আসামি করে খিলগাঁও থানায় একটি হত্যামামলা করেন। সেই মামলায় ১২ আসামিকে গ্রেপ্তারও করে পুলিশ।
নীলাদ্রির দেহে ধারালো অস্ত্রের ১২টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা। পাঁচ বছর পর ২০২০ সালের ৪ অক্টোবর ১৩ জনকে আসামি করে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র দেয় গোয়েন্দা পুলিশ। তারও দুই বছর পর গত ১৮ জানুয়ারি ১৩ আসামির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ গঠন হয়।
ডিবির পরিদর্শক শাহ মো. আক্তারুজ্জামান ইলিয়াসের দেওয়া অভিযোগপত্রে হামলাকারীদের নিষিদ্ধ সংগঠন আনসার আল ইসলামের জঙ্গি বলে শনাক্ত করা হয়েছে।
সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর সৈয়দ মো. জিয়াউল হককে প্রধান আসামি করে দেওয়া অভিযোগপত্রের অন্য আসামিরা হলেন মাসুম রানা, সাদ আল নাহিন, মো. কাওসার হোসেন খান, মো. কামাল হোসেন সরদার, মাওলানা মুফতি আব্দুল গফ্ফার, মো. মর্তুজা ফয়সল সাব্বির, মো. তারেকুল আলম ওরফে তারেক, খায়রুল ইসলাম ওরফে জামিল ওরফে রিফাত ওরফে ফাহিম ওরফে জিসান, আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাহাব, মোজাম্মেল হোসেন সায়মন, মো. আরাফাত রহমান ও মো. শেখ আব্দুল্লাহ ওরফে জুবায়ের।
যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবিতে গড়ে ওঠা রাজধানীর শাহবাগে গণজাগরণ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ২৭ বছর বয়সী নীলাদ্রি ‘ইস্টিশন’ ব্লগে ‘নিলয় নীল’ নামে লিখতেন। লেখালেখির কারণে খুন হওয়ার কিছুদিন আগে থেকে হুমকি পাচ্ছিলেন তিনি। নিরাপত্তাহীনতার কথা জানিয়ে হত্যাকাণ্ডের আড়াই মাস আগে জিডি করতে গেলেও থানা তা নেয়নি বলেও ফেসবুকে এক পোস্টে লিখে যান নীলাদ্রি।



































