• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ২৮ মাঘ ১৪৩০, ১২ শা'বান ১৪৪৬

জীবন দিয়েও সচেতন করতে পারছেন না সম্মুখসারির যোদ্ধারা


সুব্রত চন্দ
প্রকাশিত: জুলাই ৩০, ২০২১, ১০:৪৬ পিএম
জীবন দিয়েও সচেতন করতে পারছেন না সম্মুখসারির যোদ্ধারা

রাজধানীর কারওয়ান বাজার এলাকার সার্ক ফোয়ারা মোড়। চলমান লকডাউনের শুরু থেকে এই মোড়ের একটি তল্লাশিচৌকিতে দায়িত্ব পালন করছেন সার্জেন্ট আসাদুজ্জামান জুয়েল। করোনার তৃতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে প্রতিদিন রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে মাঠে থাকছেন তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের এই কর্মকর্তা।

গত মঙ্গলবার (২৭ জুলাই) পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে তল্লাশিচৌকিতে একটি মোটরসাইকেল থামান সার্জেন্ট জুয়েল। মোটরসাইকেলটিতে দুজন আরোহী ছিলেন। যারা জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হয়েছেন। তাই তাদের ট্রাফিক আইনে মামলা দেন জুয়েল। তবে ওই দুই আরোহী মামলা এড়িয়ে যেতে নানা অজুহাত দেখান। তাতেও কোনো কাজ না হওয়ায় একপর্যায়ে পুলিশকে নিয়ে নানা নেতিবাচক মন্তব্য করেন তারা। কিন্তু এমন অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতেও কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে উল্টো তাদের সংক্রমণ পরিস্থিতি বোঝানোর চেষ্টা করেন ট্রাফিক কর্মকর্তা। এই মুহূর্তে মানুষের ঘরে থাকা কতটা জরুরি, সে বিষয়ে তাদের সচেতন করেন। একপর্যায়ে মোটরসাইকেল আরোহীরা তাদের ভুল বুঝতে পেরে সেখান থেকে চলে যান।

এই চিত্র শুধু সার্ক ফোয়ারা মোড় বা এই গল্প শুধু সার্জেন্ট জুয়েলের নয়। এটি করোনার সংক্রমণকালে দায়িত্ব পালন করা প্রত্যেক পুলিশ সদস্যের গল্প। প্রতিটি তল্লাশিচৌকির চিত্র একই। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হরহামেশা এমন অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন এই সম্মুখসারির যোদ্ধারা। তারপরও হাসিমুখে মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তারা।

করোনার অতিমারিতে সবাই যখন ভীত, পরিবারের সদস্যরাও অমানবিক আচরণ করছে, তখন মানবিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দেশের এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি লকডাউন বাস্তবায়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন বাহিনীর সদস্যরা। আর এসব করতে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণও দিয়েছেন অনেকে।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যমতে, করোনা অতিমারিতে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ২৬ জুলাই পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ২৩ হাজার ৮১৪ জন পুলিশ সদস্য। তাদের মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন ১০৩ জন। রাজধানীসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়েছেন ২২ হাজার ২৮৮ জন। একক পেশা হিসেবে দেশে পুলিশ সদস্যরাই সবচেয়ে বেশি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।

২৭ জুলাই পর্যন্ত শুধু ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে (ডিএমপি) দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৬৬৫ জন। সংক্রমিত হয়ে মারা গেছেন ৩২ জন। চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়েছেন ৩ হাজার ৫৩৮ জন। এ ছাড়া র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নে (র‌্যাব) আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ১৬ জন। মারা গেছেন ৬ জন।

পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সংক্রমিত ও মৃত্যুবরণ করলেও মনোবল হারাননি নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত সম্মুখসারির যোদ্ধারা। বরং দেশের করোনা পরিস্থিতির শুরু থেকে মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করছেন তারা। কখনো লকডাউন বাস্তবায়ন তো কখনো খাদ্যসহায়তা নিয়ে হতদরিদ্রদের দোরগোড়ায় যাচ্ছেন। কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে তাকে হাসপাতালে পৌঁছে দিচ্ছেন। কেউ মারা গেলে তার দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করছেন। হতদরিদ্রদের ত্রাণসহায়তা দিচ্ছেন। এ জন্য সর্বমহলে প্রশংসিত হচ্ছেন এসব যোদ্ধা। তারপরও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে শতভাগ সচেতন হচ্ছে না সাধারণ মানুষ।

সার্জেন্ট আসাদুজ্জামান জুয়েল বলেন, “আমরা ঝুঁকি নিয়ে নিয়মিত মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আমরা চাই দেশের জনগণ ভালো থাকুক, সুস্থ থাকুক। দেশ ভালো থাকুক। কিন্তু মানুষের ভেতর এখনো সচেতনতার অভাব রয়েছে। অনেকেই নানা অজুহাতে প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হচ্ছেন। এতে তারা নিজেদের ক্ষতি করছেন, পরিবারের ক্ষতি করছেন, দেশের ক্ষতি করছেন।”

প্রত্যেক পুলিশ সদস্যকে দায়িত্ব পালনকালে অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় জানিয়ে আসাদুজ্জামান আরও বলেন, “বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে অনেকে অপ্রীতিকর আচরণ করেন, অসহযোগিতা করেন, তর্ক করেন। কিন্তু সবাই যদি সচেতন হতো, তাহলে করোনার সংক্রমণ এতটা বাড়ত না। লকডাউনেরও প্রয়োজন পড়ত না। তবে অনেকেই আবার সহযোগিতা করেন। অনেকেই যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন।”

করোনা সংক্রমণকালে যেসব সম্মুখসারির যোদ্ধা মানুষের জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের ও তাদের পরিবারের সুরক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের নতুন উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন জানান, বাংলাদেশ পুলিশের কোনো সদস্য বা তাদের পরিবারের কেউ যদি করোনায় আক্রান্ত হয়, তাকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এ জন্য পুলিশের করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল রয়েছে। যেখানে আক্রান্ত ব্যক্তিরা বিনা মূল্য চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। এ ছাড়া প্রত্যেক পুলিশ সদস্যকে করোনার টিকা দেওয়া হয়েছে। তাদের পরিবারের সদস্যদেরও টিকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যারা ঢাকার বাইরে আছেন, তাদের জন্য জেলা পুলিশ লাইনসে এসব সেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ডিসি আরও বলেন, “আমরা লকডাউন বাস্তবায়নে আইনের বিষয়টা যেমন দেখছি, তেমনি মানবিক দিকটাও দেখছি। ডিএমপির পক্ষ থেকে প্রতিদিন পাঁচ হাজার কর্মহীন মানুষকে খাবার বিতরণ করা হয়েছে। তবে শুধু আইন প্রয়োগ করে বা মানবিকতা দেখিয়ে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। প্রত্যেক মানুষকে নিজ থেকে সচেতন হতে হবে।”

পুলিশের মতোই নিজেদের সদস্যদের সুরক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে র‌্যাব। বাহিনীটি করোনার অতিমারিতে তাদের সদস্যদের দায়িত্বে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। সপ্তাহে পাঁচ দিন কাজ ও পাঁচ দিন বিশ্রামের ব্যবস্থা করেছে। বিভিন্ন ব্যারাক ও ম্যাচে থাকা সদস্যদের জন্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এমন খাবারের ব্যবস্থা করছে। যাতে করোনা সংক্রমণ থেকে তারা নিরাপদ থাকে। এ ছাড়া যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের জন্য পুলিশ হাসপাতাল, র‌্যাব সদর দপ্তরের ক্লিনিকসহ বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক হিসেবে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, “র‌্যাব নিয়োজিত ও তাদের পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার সর্বোচ্চ ব্যবস্থা করা হয়েছে। র‌্যাব সদর দপ্তরের ক্লিনিকটিতে সাম্প্রতিক সময়ে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সংক্রমণ বৃদ্ধি পেলে বেসরকারি হাসপাতালে যাতে চিকিৎসা দেওয়া যায়, সেই ব্যবস্থাও করা হয়েছে।”

করোনাকালে যাতে কারও মনোবল না হারায়, সে জন্য অধিকাংশ র‌্যাব সদস্যকে ইতিমধ্যে টিকা দেওয়া হয়েছে বলে জানান কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তবে মানুষের মধ্যে এখনো শতভাগ সচেতনতা আসেনি বলে হতাশা প্রকাশ করেন তিনি। 

আল মঈন বলেন, “আগে মানুষ মাস্ক পরিধান করতে চাইত না, এখন মাস্ক পরিধান করছে। আগে মানুষ যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলত না, এখন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে। তবে কঠোর লকডাউনেও মানুষকে ঘরে আটকে রাখা যাচ্ছে না। অনেকে অপ্রয়োজনে বাইরে বের হচ্ছে।”

সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে বিধিনিষেধ মেনে চললে সংক্রমণ পরিস্থিতি এত ভয়াবহ হতো না বলে মনে করেন র‌্যাবের এই কর্মকর্তা।

Link copied!